দেবদাস বিশ্বাস
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৯ এএম
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:০৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাস ঐতিহ্যে খোকসার কালীপূজা

ইতিহাস ঐতিহ্যে খোকসার কালীপূজা

খোকসা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম উপজেলা, যা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বিশেষ আসনে আসীন। একদিকে মুক্তিযুদ্ধে খোকসাবাসীর উল্লেখযোগ্য অবদান ও আত্মত্যাগ যেমন জাতির রক্তাক্ত ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছে; ঠিক একইভাবে বাঙালির অনুকরণীয় চেতনার প্রমাণও রেখেছে ঐতিহ্যে লালিত নদীবিধৌত এই খোকসা। একসময়ের লালন-রবীন্দ্রনাথ-মীর মশাররফের পদচারণায় মুখরিত খোকসা আজও সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা এবং মিলনমেলার গৌরবান্বিত ঐতিহ্যকে দৃঢ়তার সঙ্গে ধারণ করে; যার ধারাবাহিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খোকসার কালীপূজা।

পদ্মার শাখা নদী একসময়ের প্রমত্তা গড়াইয়ের তীরবর্তী উপজেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত খোকসা কালীপূজা মন্দির—ঐতিহ্যমণ্ডিত এক দর্শনীয় স্থান। প্রায় ছয়শ বছরের পুরোনো এই কালীপূজার ইতিহাস অনেকটাই শ্রী শ্রীকালীমাতার কৃপাধন্য অলৌকিক বাস্তবতার মোড়কে আবৃত। প্রচলিত লৌকিক ইতিহাস বিবৃত জনৈক জমিদারপুত্রের সর্পদংশন হেতু নিশ্চিত মৃত্যু পরিস্থিতিতে শ্রী শ্রীকালী মায়ের চরণধূলির মৃতসঞ্জিবনী প্রভাবের প্রমাণই সর্বপ্রথম জনমনে দেবীর জাগ্রত রূপের প্রকাশ ঘটায়। তখন অবশ্য ঠিক নদীতীরবর্তী এ স্থানটি ছিল খোকসানামক এক জাতীয় বৃক্ষবেষ্টিত জনমানবহীন এবং জঙ্গলাকীর্ণ। গহিনে বাস করতেন এক যোগী পুরুষ। মূলত তার সাধনা ও শ্রীকালী মায়ের কৃপাতেই সেই জমিদারপুত্রের প্রাণপ্রাপ্তি ঘটে। এরপর ওই যোগী সন্ন্যাসীর নির্দেশনাতেই জমিদারবাবু সাড়ে সাত হাত দীর্ঘ কালীমূর্তি নির্মাণ করে মাঘী অমাবস্যা তিথিতে জমকালো আয়োজনে সর্বপ্রথম পূজার পরিসরে সর্বজনীনতার সূত্রপাত ঘটান।

সময়ের পরিক্রমায় শ্রী শ্রীকালী মায়ের করুণারূপ আরও অনেক অলৌকিকতার বাস্তব প্রকাশ ঘটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এই পূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকেন জমিদাররা; যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের কুষ্টিয়ার শিলাইদহকেন্দ্রিক জমিদার ঠাকুররা, রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার জমিদার ভৈরবনাথ, ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলডাঙ্গার জমিদার ইন্দ্রভূষণ দেব রায়, নড়াইলের প্রতাপশালী জমিদার রতনবাবু প্রমুখ। জমিদারদের সম্পৃক্ততায় পূজা এবং পূজা-পরবর্তী নানারকম আনন্দ আয়োজন হতে থাকে বেশ ধুমধামের সঙ্গে। প্রতি বছর একই তিথিতে শুদ্ধাচারের প্রতি পালনের মধ্য দিয়ে এ পূজা হয়ে থাকে। মাঘী অমাবস্যার এক মাস পূর্বে কদম কাঠের কাঠামো তৈরি করা হয় এবং দক্ষ ভাস্করের হাতের কারুকার্যে ক্রমে তাতেই ঈশ্বরের মাতৃমূর্তি বিকশিত হয়। অমাবস্যা তিথিতে পূজার প্রথম পর্ব সম্পন্ন হয় এবং পূজার দ্বিতীয় পর্ব সম্পন্ন হয় প্রথম পর্ব থেকে সপ্তমতম দিন সপ্তমী তিথিতে।

রাজা-জমিদারদের সম্পৃক্ততা মানেই রাজসিকতার রং-রূপ-রসের বাহুল্য। খোকসার শ্রী শ্রীকালী মায়ের পূজাতেও সেই বাহুল্যের ব্যতিক্রম ঘটেনি। আধ্যাত্ম চেতনার পুণ্য-পবিত্র প্রথার সঙ্গে কুপ্রথারও প্রচলন ঘটেছে। এই অনন্যসাধারণ পূজার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আদিতে যে যোগী সন্ন্যাসী এই পূজা করতেন, তিনি মহিষ, পাঁঠা বা ছাগল বলির মতো শাস্ত্রবহির্ভূত প্রথা পালনের মধ্য দিয়ে পূজা অনুষ্ঠান করেননি। তিনি ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। তাই তিনি ‘যুগধর্ম’ এবং শাস্ত্রীয় তাৎপর্য অনুযায়ী হিন্দুধর্মের অন্যতম সিদ্ধ সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নির্দেশিত পথে ভক্তিযোগে শ্রী শ্রীকালী মায়ের পূজার অনুষ্ঠান করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব কখনোই মায়ের পূজাতে কোনো পশু বলি দেননি। মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১১৫ অধ্যায়ে বলা হয়েছে—যে ব্যক্তি পূজাতে পশু বিনাশ করে, তাকে নিশ্চয়ই ‘নিরয়গামী’ অর্থাৎ নরকগামী হতে হয়। সনাতন শাস্ত্র সিদ্ধান্ত এই যে, যারা বলি দেবার নিমিত্তে পশু আহরণ, পশুবলিতে অনুমতি প্রদান বা স্বয়ং বলি দেয়, তারা সকলেই ঘাতকের তুল্য পাপে লিপ্ত হয়। যাহোক, খোকসার কালীপূজাতে জমিদারকর্তৃক প্রচলিত শাস্ত্রসিদ্ধান্তবহির্ভূত কুসংস্কারের ‘বলি প্রথা’ আজও প্রতিপালিত হচ্ছে। এটি পূজার পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করে বৈকি।

খোকসার কালীপূজার মেলা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম মেলা। জমিদারদের সময়ে পূজাকে কেন্দ্র করে এক মাসের অধিক সময় মেলা চলত। আজও খোকসার এই মেলা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়—সৃষ্টি হয় উৎসবমুখরতা। খোকসার কালী পূজার ভক্তিময় প্রভাব দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সাড়া জাগায়। প্রতি বছর সেখান থেকেও হাজার হাজার ভক্ত ও পুণ্যার্থী আসেন খোকসা কালী মায়ের দর্শনে। পূজার সুষ্ঠু আয়োজনে প্রতি বছরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে থাকে। ফলে নির্বিঘ্নে পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীসহ ভক্তরা আনন্দচিত্তে পূজা ও মেলা উপভোগ করে থাকেন।

যাই হোক, বার্ষিক আয়োজনই খোকসা কালীপূজার একমাত্র তাৎপর্য নয়। সার্বিক বিবেচনায় এটি মানুষের মনে যে সম্প্রীতির সেতুবন্ধ সৃষ্টি করে; তা আঞ্চলিক সমাজজীবনে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়। পূজা ও মেলা বছরের নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠিত হলেও দেশ-বিদেশের পর্যটনপ্রেমী দর্শনার্থী সারা বছরই খোকসার শ্রী শ্রীকালী মায়ের পবিত্র প্রাঙ্গণে এসে নিজেদের ধন্য মনে করেন। সরকারি সুবিবেচনায় এ মন্দির এবং মন্দিরসংলগ্ন অঞ্চলকে অবকাঠামোগতভাবে উন্নত করা গেলে ঐতিহ্যে অনন্য খোকসার শ্রী শ্রীকালী মায়ের মন্দিরকেন্দ্রিক একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে।

লেখক: ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ

রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভুটানকে হারিয়ে সাফে শুভ সূচনা বাংলাদেশের

৩১ দফার সমর্থনে বিএনপি নেতা ফয়সাল আলীমের গণসংযোগ ও পথসভা

ভারতে আ.লীগের রাজনৈতিক অফিস চালু নিয়ে কড়া অবস্থানে সরকার

সাতক্ষীরায় জেল পলাতক ১১ মামলার আসামি গ্রেপ্তার

প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শিক্ষিকাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা স্কুলছাত্রের

শিল্টনের বিশ্বরেকর্ড ভেঙে ইতিহাস গড়লেন ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার

ফিল্ম স্টাইলে ব্যবসায়ীর বসতঘরে গুলি

জানা গেল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে চুলের মুঠি ধরে চড় মারার কারণ

ঘরের ভেতর জামাকাপড় শুকাচ্ছেন? হতে পারে যেসব বিপদ

ডিএমপির সাবেক এডিসি নাজমুল বরখাস্ত

১০

বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নতুন প্ল্যাটফর্ম উদ্বোধন

১১

পাথরকাণ্ডে দুদকের তালিকায় সেই মোকাররিম

১২

একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির প্রথম ধাপের ফল প্রকাশ, দেখবেন যেভাবে

১৩

‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলে সেই মাহিন সরকারসহ প্রার্থী হলেন যারা

১৪

জানা গেল আইসিসি র‍্যাঙ্কিং থেকে রোহিত-কোহলির নাম মুছে যাওয়ার কারণ

১৫

অনুমতি ছাড়া ছবি-ভিডিও ব্যবহার নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রভা

১৬

অভিজ্ঞতা ছাড়াই অর্ধলাখের বেশি বেতনে চাকরির সুযোগ

১৭

ডিএমপির বোম ডিসপোজাল ইউনিটের উচ্চতর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন

১৮

হাসপাতাল পরিচ্ছন্নতা অভিযানে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা

১৯

চ্যাটজিপিটির ভুল তথ্যে বিপাকে পড়লেন তরুণী

২০
X