মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:১০ এএম
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষুদ্র ঋণ আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখছে

ক্ষুদ্র ঋণ আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখছে

বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে মাইক্রোফাইন্যান্স একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছে, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবিকা উন্নত করার পাশাপাশি তাদের ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো (এমএফআই) অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা লাখ লাখ মানুষকে আর্থিক সেবা প্রদান করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জীবনমান উন্নত করতে, আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করতে এবং সমাজে অর্থপূর্ণ অবদান রাখতে সহায়তা করেছে। তবে, এই উদ্যোগে এখনো সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র অংশকে সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করার চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্যা রুরাল পুওর (ডরপ) বিশ্বাস করে, আর্থিক সুযোগপ্রাপ্তি একটি মানবাধিকার। ডরপের মতে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি শুধু ঋণ প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়—এর মধ্যে সঞ্চয়, আমানত এবং অর্থ প্রেরণ সেবাও অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে দেশের অনেক মানুষ, বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ এখনো ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে মাইক্রোফাইন্যান্স একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটা বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাদের ব্যাংকের দৃষ্টিতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সীমিত বলে বিবেচিত, তাদের জামানত ছাড়াই আর্থিক সেবা প্রদান করছে, যা তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে মাইক্রোফাইন্যান্স খাত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে। তবে, সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া বড় উদ্বেগের বিষয়। তাদের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে ঋণের যোগ্যতা অর্জনে অক্ষম মনে করা হয়। ফলে তারা এই সেবার বাইরে থেকে যায়, যা দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তোলে।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ৭৩১টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যা প্রায় ৪০ কোটি ৮ লাখ ৬০ হাজার সদস্যকে সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে ৩১ কোটি ৫৩ লাখ সক্রিয় ঋণগ্রহীতা রয়েছেন। এই খাতে মোট ঋণ বকেয়া রয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। (তথ্যসূত্র: মাইক্রোফাইন্যান্স ইন বাংলাদেশ, বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩)। এ খাত সরাসরি ঋণ প্রদানের পাশাপাশি ২৫ হাজার ৩৩৬টি শাখার মাধ্যমে ২ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিচ্ছে।

মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা উল্লেখযোগ্য। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই দশকে মাইক্রোফাইন্যান্স গ্রামীণ দারিদ্র্য ১০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে এবং প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশিকে দারিদ্র্যের সীমা অতিক্রম করতে সহায়তা করেছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনো দেশের ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ (মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ) চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে, যার মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ গুরুতর সংকটে রয়েছে। এই অংশের অনেকেই মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোগ্রামের বাইরে রয়ে গেছে, যা আর্থিক সেবার সুবিধা সর্বাধিক প্রান্তিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরালো করে তোলে (তথ্যসূত্র: ইউএনডিপি ২০২৪)।

মাইক্রোফাইন্যান্সে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা নারী হলেও মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে যে, ঋণ নারীদের নামে নেওয়া হলেও এর ব্যবহার করে থাকেন তাদের স্বামীরা। যদিও নারীরা ব্যবসা বা উদ্যোক্তা কার্যক্রমে যুক্ত, নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের চিত্র এখনো পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায়নি।

মাইক্রোফাইন্যান্স খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও এটি এখনো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অতিরিক্ত ঋণের বোঝা একটি বড় সমস্যা। অনেক ঋণগ্রহীতা একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন; কিন্তু তা সঠিকভাবে পরিচালনা করার জ্ঞান বা দক্ষতার অভাবে ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হন। এ ছাড়া ঋণের অপব্যবহারও একটি বড় সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, সহজে প্রাপ্ত জাগরণ ঋণ কখনো কখনো আয়বর্ধনকারী কাজের জন্য নেওয়া হলেও তা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা হয়। এ সমস্যাগুলো মাইক্রোফাইন্যান্স খাতে মনিটরিং বাড়ানো এবং ঋণগ্রহীতাদের আরও প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

এ ধরনের সমস্যাগুলো সমাধানে মাইক্রোফাইন্যান্স কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পিকেএসএফ ১৪ হাজার কোটি টাকার বিশাল মূলধন দিয়ে পিকেএসএফের সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ২ কোটি মানুষকে আর্থিক সেবা প্রদান করছে এবং ৩৫ লাখ ছোট ব্যবসার মালিককে সহায়তা করছে (তথ্যসূত্র: পিকেএসএফ বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩)। এ ছাড়া ২০২৩ সালে মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৭ শতাংশ তহবিল ব্যাংক থেকে আসছে, যা কম টেকসই ঋণ বিকল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে (তথ্যসূত্র: অ্যালায়েন্স ফর ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন (এএফপি) গ্লোবাল ২০২৩)।

মাইক্রোফাইন্যান্সকে কার্যকর করতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উপায় গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ হলো অতিদরিদ্রদের কাছে পৌঁছানোর উপায় খুঁজে বের করা, ঋণ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ঋণগ্রহীতাদের শিক্ষা প্রদান করা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও সামাজিক সেবার মতো অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান করা। ঋণগ্রহীতাদেরও ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ প্রয়োজন, যা তাদের জীবনমান উন্নত করতে এবং ঋণ পরিশোধে সহায়তা করবে। দেখা গেছে, যদি তারা ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ পায়, তাহলে তারা সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ করে। অর্থায়নের সুযোগ শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এই স্বীকৃতি একটি ন্যায়সংগত এবং আরও সমতাপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়তা করতে পারে।

মাইক্রোফাইন্যান্স এরই মধ্যে বাংলাদেশের অনেক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে, এখনো সবার কাছে মাইক্রোফাইন্যান্সের সুবিধা পৌঁছানোর জন্য বেশ কিছু কাজ বাকি। এর বিদ্যমান দুর্বলতাগুলো সমাধান করে এবং সাফল্যের ভিত্তিতে কাজ করলে, মাইক্রোফাইন্যান্স দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে আরও বড় প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে তা মাইক্রোফাইন্যান্স বা গ্রামীণ উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে হোক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এর ফলে ধীরে ধীরে বৈষম্যও কমে আসবে, যা একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।

লেখক: উপনির্বাহী পরিচালক, ডরপ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৃষ্টিতে বাইক চালাতে সাবধান না হলে বিপদ

যুবকের কাণ্ডে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ

২০২৬ সালে রোজা শুরু হতে পারে যেদিন থেকে

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে রিভিউ আবেদনের শুনানি ফের আজ

সকালে উঠে ভুলেও করবেন না এই ৫ কাজ

উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা কাজী নজরুল : রিজভী

কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ, কচুরিপানার নিচে মিলল লাশ

সপ্তাহের ব্যবধানে সাড়ে ৪ হাজার সেনা হারাল ইউক্রেন

অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পদে নিয়োগ দিচ্ছে আড়ং

১০

রাজধানীতে আজ কোথায় কোন কর্মসূচি

১১

এসিআই-এ নিয়োগ, আবেদন করুন অনলাইনে

১২

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৩

বসতভিটা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি, সন্তানের বিরুদ্ধে বাবার মামলা

১৪

ব্রাজিলের মন্ত্রীর মার্কিন ভিসা বাতিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেন লুলা

১৫

ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে রুমমেটকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, কী বললেন প্রক্টর

১৬

শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ আটক

১৭

২৭ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৮

২৭ আগস্ট : টিভিতে আজকের খেলা 

১৯

আজ থেকে নতুন দামে বিক্রি হবে স্বর্ণ

২০
X