আহমাদ ইবসাইস
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গাজানীতি জেনিনে সফল হবে না

গাজানীতি জেনিনে সফল হবে না

গত জানুয়ারির ঘটনা। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করার সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জেনিন শহর ও সেখানকার শরণার্থীশিবিরে অভিযান চালানোর ঘোষণা দেয়। সেই থেকে তিন সপ্তাহ ধরে তারা সেখানে ফাইটার জেট, হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক, ড্রোন ও বুলডোজার দিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে যাচ্ছে। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বের উদাসীনতায় সাহস পেয়ে ইসরায়েলি সরকার জেনিনসহ পশ্চিম তীরে গাজার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করছে। তবে জেনিন ও অন্যান্য শরণার্থীশিবিরে এই ‘গাজাফিকেশন’ পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। যেমন অতীতেও তাদের এ কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েল কেন জেনিনকে তাদের রক্তক্ষয়ী হামলার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে তার স্পষ্ট কারণ রয়েছে। ১৯৪৮ সালের নাকবার পর আট হাজার ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করে এখানে পুনর্বাসন করা হয়। সেই থেকে প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত জেনিন।

আরবি নাকবা (Nakba) মানে বিপর্যয় বা মহাদুর্যোগ। ফিলিস্তিনিদের জন্য এক স্মরণীয় ও বেদনাদায়ক অধ্যায়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় যে গণবিপর্যয় ঘটে, তা বোঝাতে ‘নাকবা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ‘Partition Plan’ অনুযায়ী ব্রিটিশ অধিকৃত ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়—একটি ইহুদিদের জন্য, অন্যটি ফিলিস্তিনিদের জন্য। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। কারণ এখানে তারা প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে। এটি তাদের দেশ। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের হত্যা, ধর্ষণ, গ্রাম ধ্বংস এবং তাদের বিতাড়িত করে। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধের ফলে সাড়ে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনি (সে সময়ের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ) শরণার্থী হয়ে পড়ে। তাদের পাঁচ শতাধিক গ্রাম ও শহর ধ্বংস করা হয়। এটাই নাকবা। প্রতি বছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস (Nakba Day) পালন করে, যা তাদের জাতিগত নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রতিরোধের প্রতীক।

জেনিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রথম ইন্তিফাদার সময়, যখন বহু ফিলিস্তিনি সংগঠন এখানে গড়ে ওঠে। আরবি ইন্তিফাদা হলো জাগরণ বা বিদ্রোহ। শব্দটি মূলত ইসরায়েলি শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের গণআন্দোলন ও প্রতিরোধ সংগ্রামকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ফিলিস্তিনে দুটি প্রধান ইন্তিফাদা সংঘটিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে একটি বিক্ষোভ শুরু হয়, যা দ্রুত সারা ফিলিস্তিনে ছড়িয়ে পড়ে। এটাই প্রথম ইন্তিফাদা। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা হয় ২০০০-২০০৫ সালে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে অসলো চুক্তির পরও ইসরায়েল বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখে এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন বাড়ায়। ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা এরিয়েল শ্যারন মুসলমানদের পবিত্র আল-আকসা মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করেন, যা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে। এ ঘটনার পর ফিলিস্তিন জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ২০০২ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলি বাহিনী জেনিন আক্রমণ করে। এ ঘটনায় ৫২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। শত শত ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং এক-চতুর্থাংশ জনগণকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। তখন ইসরায়েল দাবি করে, তারা সন্ত্রাস ধ্বংস করেছে। কিন্তু জেনিনের ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন প্রজন্ম উঠে আসে। তারা আজও প্রতিরোধের অবিচল ইচ্ছাশক্তি বহন করে চলেছে। ২০২০-এর দশকে জেনিন ও অন্যান্য শরণার্থীশিবিরে সশস্ত্র প্রতিরোধ তীব্র হয়। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে গাজায় গণহত্যার কয়েক মাস আগে ইসরায়েল পুনরায় জেনিনে ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালায়। ফাইটার জেট, সশস্ত্র ড্রোন, ট্যাঙ্ক ও হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করে ১০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বহু ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো ধ্বংসসহ হাজারো মানুষকে করা হয় বাস্তুচ্যুত। তবু প্রতিরোধ আবারও শক্তিশালী হয়। গাজার ডাকে সাড়া দেয় জেনিন।

জেনিন প্রতিরোধের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। কারণ শরণার্থীশিবির শুধু টিকে থাকার জায়গা নয়, এগুলো ফিলিস্তিনি চেতনার স্পন্দন। নাকবার ক্ষত ও যন্ত্রণা এখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। সন্তানরা তাদের মা-বাবা ও দাদাদের ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়।

শিশুরা প্রতিদিন দেখে তাদের পাড়া লন্ডভন্ড হচ্ছে। তাদের বন্ধুরা বন্দি হচ্ছে। খুন হচ্ছে। এই সেদিন ২৮ জানুয়ারি যেমন ১০ বছর বয়সী সাদ্দাম রজবকে তুলকারেমে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে। তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়া হয়। ঘটনার ১০ দিন পর সে মারা যায়। শরণার্থীশিবিরের শিশুরা স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের কঠিন মূল্য জানে। তবু তারা এ মূল্য দিতে প্রস্তুত।

গাজা উপত্যকায়, জাবালিয়া শিবিরও প্রতিরোধের শক্ত ঘাঁটি ছিল। এটি ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির। এখানে এক লাখ মানুষ বাস করত। ১৯৮৭ সালে এখান থেকেই প্রথম ইন্তিফাদার সূত্রপাত হয়। বারবার ইসরায়েলি সামরিক হামলার শিকার হয়েছে। চরম আঘাত সহ্য করেছে এটি গণহত্যার।

ইসরায়েলি বাহিনী জাবালিয়ায় একাধিক হামলা চালায়। প্রতিবার একই কৌশলে—ব্যাপক বোমাবর্ষণ, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং বেসামরিক লোকজনকে বাস্তুচ্যুত করে। প্রতিবার তারা দাবি করে, প্রতিরোধ নির্মূল করেছে। কিন্তু কয়েক মাস পরই নতুন করে ‘ক্লিয়ারিং অপারেশন’ চালায়।

গত শরতেও ইসরায়েল জাবালিয়ায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। ফলে ৯০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। তবু প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিআক্রমণ চালিয়ে যেতে দেখা যায়।

জেনিনে চলমান হামলাও একই ব্যর্থ কৌশল অনুসরণ করছে। ৪৫ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই বছর বয়সী লায়লা আল-খাতিবও রয়েছে। ২০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। হাসপাতাল অবরুদ্ধ করা হয়েছে। শহরকে পশ্চিম তীরের অন্যান্য অংশ থেকে করা হয়েছে বিচ্ছিন্ন। এ সামরিক ধ্বংসযজ্ঞ জেনিনে আগেও সফল হয়নি। সফল হয়নি গাজায়ও। তাহলে ইসরায়েল কেন মনে করে, এবার তারা সফল হবে? ইসরায়েলের এ সামরিক কৌশল তাদের মৌলিক অন্ধত্বই প্রকাশ করে। তারা প্রতিরোধকে শুধু শারীরিক বস্তু মনে করে—যোদ্ধা হত্যা করতে হবে, সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে হবে, নেতা হত্যা করতে হবে, অস্ত্র জব্দ করতে হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনের শরণার্থীশিবিরে প্রতিরোধ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়। এটি গল্পগাথায় বেঁচে থাকে। অবরোধের মধ্যেও টিকে থাকে মর্যাদার অবিচল দৃঢ়তায়। ধ্বংসের পরও বেঁচে থাকে পুনর্গঠনের সংকল্পে।

এ ইতিহাস আগেই লেখা হয়ে গেছে। জেনিন, জাবালিয়াসহ ফিলিস্তিনের প্রতিটি শরণার্থীশিবিরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সাময়িক আশ্রয়কে স্থায়ী প্রতিরোধের স্মৃতিসৌধে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি আগ্রাসনের সঙ্গে, প্রতিটি ধ্বংসের সঙ্গে, প্রতিটি সম্প্রদায়কে দুর্বল করার প্রচেষ্টার সঙ্গে প্রতিরোধ আরও দৃঢ় হয়। এটি বেঁচে থাকে সেই শিশুর দৃঢ় পদক্ষেপে, যে চেকপয়েন্ট পার হয়ে স্কুলে যাচ্ছে; সেই প্রবীণের হাসিতে, যে তার বাড়ি আবার গড়ে তুলছে এবং সেই সম্মিলিত প্রত্যাখ্যানে, যারা বাস্তুচ্যুতিকে তাদের নিয়তি হিসেবে মেনে নেয় না। এ কারণেই জেনিনের ‘গাজাফিকেশন’ ব্যর্থ হবে। আপনি বিপ্লবীদের হত্যা করতে পারেন, কিন্তু বিপ্লবকে হত্যা করতে পারবেন না। আপনি একটি ধারণাকে বোমার মাধ্যমে পরাস্ত করতে পারবেন না। আপনি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করতে পারবেন না।

লেখক: আইন শিক্ষার্থী, প্রথম প্রজন্মের ফিলিস্তিনি-আমেরিকান। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন আবিদুর রহমান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করল যুক্তরাষ্ট্র

খুলনায় পিকআপ-ইজিবাইক সংঘর্ষে নিহত ২ 

বিপাকে পড়েছেন শ্রদ্ধা কাপুর

বিয়ের আগে মা হওয়া নিয়ে গর্ববোধ করেন নেহা ধুপিয়া

পেনাল্টি মিসের দোষ রেফারির ঘাড়ে চাপালেন ম্যানইউ অধিনায়ক

৪ ইভেন্টে ৩ রেকর্ডে যে বার্তা দিলেন রিংকি

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন অন্যতম প্রতিভাবান ক্রিকেটার

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ নাহিদের

গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে যে ভয়ের কথা জানালেন তৌহিদ আফ্রিদি

সুনামগঞ্জে বালু-পাথর লুট ঠেকাতে বিজিবির অভিযান

১০

টি-টোয়েন্টিতে অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়ে যা বললেন সাকিব

১১

ইসির শুনানিতে হট্টগোল / রুমিন ফারহানার সমর্থকদের মহাসড়ক অবরোধ, এনসিপির বিক্ষোভ 

১২

কারাগারে বিক্রমাসিংহে, মুখ খুললেন সাবেক তিন প্রেসিডেন্ট

১৩

গোল্ডেন হারভেস্টে বড় নিয়োগ

১৪

যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন ভিসার ফি বাড়ছে দ্বিগুণের বেশি

১৫

জুম টিভির অফিসে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান

১৬

ধেয়ে আসছে শক্তিশালী ঝড়, ৬ লাখ মানুষকে সরানোর নির্দেশ 

১৭

হাসপাতালে বাণিজ্যিক নার্সারি, সন্ধ্যায় বসে মাদকসেবীদের আড্ডা

১৮

ইহুদিবিদ্বেষ ইস্যুতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করল ফ্রান্স

১৯

টিভিতে আজকের খেলা

২০
X