ড. মো. আক্তারুজ্জামান খান
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রাম্পের মার্কেন্টিলিজম টিকবে কি

ট্রাম্পের মার্কেন্টিলিজম টিকবে কি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে আমদানির ক্ষেত্রে ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপ করবেন। এ পাল্টা শুল্কের উদ্দেশ্য আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে দেশের জনগণকে সম্পদশালী করা। উনার যেই কথা সেই কাজ। যথারীতি গত ২ এপ্রিল প্রায় ৯০টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে আমদানির ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করলেন। এ যেন ৩০০ বছর আগের মার্কেন্টিলিজম (Mercantilism) অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়া। মার্কেন্টিলিজম ছিল ১৬-১৮ শতকের প্রচলিত একটি অর্থনৈতিক নীতি, যেখানে রাষ্ট্রসমূহ ধন-সম্পদ বৃদ্ধির জন্য রপ্তানিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিত এবং আমদানি নিরুৎসাহিত করত। মূল লক্ষ্য ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্য মজুত বৃদ্ধি করা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘পাল্টা শুল্ক’ নীতি মূলত মার্কেন্টিলিজমের একটি আধুনিক রূপ, যেখানে কোনো দেশের শুল্কের মাত্রার সঙ্গে মিল রেখে আমদানিতে শুল্ক বসানো হলো। ফলে সারা বিশ্বে এখন একটি বাণিজ্যযুদ্ধ বিরাজ করছে। এখন প্রশ্ন হলো, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী ট্রাম্প কেন ৩০০ বছর আগের বাণিজ্য অর্থনীতিতে ফিরে গেলেন? এ মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে তিনি কি এই বাণিজ্যনীতিতে অটল থাকতে পারবেন?

২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯১৮ বিলিয়ন ডলার। যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চীন (প্রায় ২৭০ বিলিয়ন ডলার), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার), মেক্সিকো (প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলার) ও ভিয়েতনামের (প্রায় ১১০ বিলিয়ন ডলার) সঙ্গে। ট্রাম্প বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার জন্যই নতুন মার্কেন্টিলিজম ব্যবস্থায় ফিরে গেলেন। পাল্টা শুল্কহার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যে নীতি অনুসরণ করেছেন তা হলো—কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ওপর যে হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করে তার অর্ধেক। পাল্টা শুল্ক আরোপের ট্রাম্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেসব দেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি আছে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমেরিকান পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো। এতে আমেরিকান পণ্যের রপ্তানি বাড়বে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথমেই তিনি কানাডার ওপর পাল্টা আমদানি শুল্ক আরোপ করলেন। কিন্তু কানাডা এটা মেনে না নিয়ে বরং উল্টো শুল্ক আরোপ করল। পরিশেষে ট্রাম্প কানাডার ক্ষেত্রে পাল্টা আমদানি শুল্কনীতি পরিহার করলেন।

৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এশিয়াসহ আমেরিকার শেয়ার মার্কেটে পতন ঘটে। কমে যায় বিশ্বের সব নামকরা কোম্পানির শেয়ারের দাম। ১০ এপ্রিল ২০২৫, সব দেশের অনুরোধে ৭৫টি দেশের ওপর থেকে পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন মাসের জন্য পাল্টা শুল্ক স্থগিতের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। শুধু চীন পাল্টা শুল্ক স্থগিতের আবেদন না করে বরং উল্টো আমেরিকান পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক আরও বাড়িয়ে দেয়। রাগান্বিত ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়াতে বাড়াতে ১৪৫ শতাংশে পৌঁছান। অন্যদিকে চীন আমেরিকান পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। তবে আশার বিষয়, ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে চাচ্ছেন।

মানুষের চাহিদা এবং চাহিদার বৈচিত্র্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক শ্রম বিভাজন ও শ্রমের উৎপাদনশীলতার ব্যবহারের ফলে স্থানভেদে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হয়েছে। পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক অর্থনীতির তুলনামূলক সুবিধা নীতি ব্যবহারের ফলে এক দেশ অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতির আবির্ভাব ঘটেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি বহুজাতিক কোম্পানি, বিদেশি বিনিয়োগ এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প গত ১০০ বছরের প্রচলিত একটি বিশ্ব বাণিজ্যনীতি একটি আদেশের মাধ্যমে ছুড়ে ফেলে দিলেন। আমেরিকান মানুষকে সম্পদশালী করার জন্য চলে গেলেন ৩০০ বছরের পুরোনো সেই মার্কেন্টিলিজম নীতিতে। একদিনের মধ্যে ধস নামিয়ে দিলেন বিশ্ব অর্থনীতিতে। যদিও ১৮ ঘণ্টার মধ্যে ৭৫টি দেশের ওপর পাল্টা শুল্কহার তুলে নিয়েছেন। এই নীতি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করলে প্রথমেই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকান ভোক্তারা। বেড়ে যাবে সব নিত্যপণ্যের দাম। যেটার প্রভাব এরই মধ্যে আমেরিকান বাজারে পড়তে শুরু করেছে। শুধু বৃহস্পতি ও শুক্রবারেই, সপ্তাহান্তে আমেরিকান শেয়ারবাজার বন্ধ হওয়ার আগেই ৬.৬ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্ষতি হয়েছে।

শোনা যাচ্ছে, পাল্টা শুল্ক আরোপের মূল বুদ্ধিদাতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা পিটার নোভারু যিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী। নোভারুর বাণিজ্যনীতিতে ইলন মাস্ক ক্ষেপে গিয়ে তার হার্ভার্ড ডিগ্রির সমালোচনা করেছেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে নিজেকে ধনী করার জন্য অন্যের ওপর শুল্ক চাপিয়ে দাদাগিরি করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে অন্য দেশগুলো নতুন বাজার খুঁজে নেবে এটাই স্বাভাবিক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচিত হবে আমেরিকান পণ্যের ওপর যে দেশের আমদানি শুল্ক বেশি, সেই দেশগুলোর সঙ্গে ভিন্নভাবে বসা এবং আমদানি শুল্ক একটি যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসা। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে মার্কেন্টিলিজম ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। এ চেষ্টা অব্যাহত রাখলে পৃথিবী আবার ১৯৩০ সালের মতো মহামন্দার কবলে পড়বে। এতে কোনো দেশই লাভবান হতে পারবে না।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিক্ষা খাতে চীনের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে : ইউজিসি চেয়ারম্যান

ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের নতুন মোবাইল অ্যাপ ‘উমা’ উদ্বোধন

আর্জেন্টাইন গায়িকার প্রেমে ভালোই মজেছেন ইয়ামাল

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে : ড. ফরিদুজ্জামান

রাকসু নির্বাচন / দ্বিতীয় দিনে মনোনয়ন তুলেছেন ১৬ প্রার্থী

দ্বিতীয় দিনের মতো মহাসড়ক অবরোধ ববি শিক্ষার্থীদের

৭ জেলায় নতুন পুলিশ সুপার

ডাকসু নির্বাচন / লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার অভিযোগ ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের 

ট্রাম্পের ভুল সমীকরণ, চীনের ফাঁদেই ধরা যুক্তরাষ্ট্র!

নিজ সন্তানকে কোলে নিতে আদালত প্রাঙ্গণে বাবার কান্না

১০

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘কাজিকি’, সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে

১১

সরকারি নিয়োগ নিয়ে জরুরি নির্দেশনা 

১২

প্রাণ ফিরছে সাদাপাথরে, বাড়ছে পর্যটকের ভিড়

১৩

রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ১১ দেশের

১৪

নির্বাচনে নয়, দায়িত্বে থাকতে চান বিসিবি সভাপতি বুলবুল

১৫

ভিকারুননিসা-হবিগঞ্জের ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের ক্ষোভ প্রকাশ

১৬

সিলেটে কুরিয়ার ভ্যানে ডাকাতি, গ্রেপ্তার ৬

১৭

ফেসবুকে প্রেম, বিয়ে করতে কুষ্টিয়ায় চীনা যুবক

১৮

গুণী অভিনেত্রী জাহানারা ভূঁইয়ার ইন্তেকাল

১৯

ইতিহাস আমাদের বিচার করবে : মুসলিম দেশগুলোর উদ্দেশে ইরান

২০
X