ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাডলাকের কপাল খারাপ

ব্যাডলাকের কপাল খারাপ

সেনাবাহিনীর যে কোনো প্রশিক্ষণই কষ্টসাধ্য। তবে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে নতুন যোগ দেওয়া ক্যাডেটদের প্রথম ছয় মাসের প্রশিক্ষণের কষ্টের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। এ সময়টায় সকলের জুনিয়র হিসেবে ক্রমাগতভাবে সিনিয়রদের আদেশ মান্য করতে হয় এবং যখন-তখন শারীরিক ও মানসিক শাস্তি পেতে হয়। কথায় কথায় শুনতে হয় ‘বিএমএর মশা মাছিও তোমাদের সিনিয়র’ এমন সব মন্তব্য। তার ওপর যুক্ত হয় অফিসার এবং নন-কমিশন্ড অফিসার (অফিসারদের চেয়ে নিম্ন পদবির সৈনিক) প্রশিক্ষকদের কড়া প্রশিক্ষণ এবং এদিক-ওদিক হলেই কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি। মূলত বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন ভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা সব ক্যাডেটের ব্যক্তিগত ইগো বা অহংবোধ ভেঙে মেধা ও মননে পরিপূর্ণভাবে কেবল সামরিক ব্যক্তিত্ব রূপে গড়ে তুলতেই একযোগে এমন চাপে রাখা হয় নতুন ক্যাডেটদের।

তখন তারা নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধু আদেশ মানা আর না মানলে শাস্তি— এ কথাই মনে রাখতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে নিজের বাবার নাম ভুলে যাওয়াও বিচিত্র ঘটনা নয়। এর ওপর বাড়তি যোগ হয় শুধু ইংরেজিতে কথা বলার বাধ্যবাধকতা। শুদ্ধ বাংলাই যখন মনে থাকে না, তখন ইংরেজিতে কথা বলার সঠিক ধরন এবং তার বিশুদ্ধতা প্রত্যাশা করাও কঠিন। ফলে ভুল ইংরেজি হয়ে ওঠে কথা বলার একমাত্র মাধ্যম। আর সেই ভুল ইংরেজির অন্যতম অনুষঙ্গ ইংরেজির সঙ্গে বাংলার নির্বিচার মিশেল, যা তথাকথিত ‘বাংলিশ’ নামে পরিচিত।

একবার একজন নতুন ক্যাডেট দৌড়ের সময় রাস্তায় পড়ে ব্যথা পায়। অফিসার প্রশিক্ষক এসে ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? নতুন ক্যাডেট উত্তর করলেন, ‘আই স্যার, রোড স্যার, রান স্যার, ফল সার, উহ্ স্যার, হাঁটু স্যার, পেইন স্যার, গো হসপিটাল স্যার।’ এমন ইংরেজি শুনে অফিসার প্রশিক্ষক স্বভাবজাত ইংরেজি ভাষায় যা বললেন, তার মর্মার্থ হলো—‘ইংরেজরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপর প্রায় ২০০ বছর অত্যাচার করেছে। তার প্রতিশোধ নিতে তোমরা কয়শ বছর তাদের ভাষার ওপর অত্যাচার করবে কে জানে?’

এমন সামরিক প্রশিক্ষণের শুরুর দিকে এক নতুন ক্যাডেট তার পকেটে থাকা একটি কাগজ হারিয়ে ফেলে, যা অফিসে জমা দেওয়ার কথা ছিল। কাগজটি জমা দিতে না পারায় প্রশিক্ষক ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে এ কাগজটি হারাল। নতুন ক্যাডেটের তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল—‘ব্যাডলাকের কপাল খারাপ স্যার।’ অর্থাৎ নিতান্ত ভাগ্য খারাপ বলেই কাগজটি হারিয়ে যায়।

সেই ‘ব্যাডলাকের কপাল খারাপ’ কথাটি মনে পড়ল সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মণদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের খবর শুনে।‌ তার নাম লাক মিয়া। তার লাক বা কপাল ভালোই ছিল। বলা চলে এতই ভালো ছিল যে, তিনি পরপর তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত(?) বা মনোনীত হন। আর ভোটের জন্য যখন জনগণের কাছে যাওয়ার বদলে দলীয় নমিনেশন ও আশীর্বাদ পেতে উচ্চমহলের জন্য টাকা-কড়ি আর নারী-বাড়ি লাগে, তখন এমন চেয়ারম্যানদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র হয়ে ওঠে। লাক মিয়াও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে লাক মিয়ার ব্যাডলাকের কপাল খারাপ। পবিত্র রমজান মাসের শুরুতেই লাক মিয়ার অপবিত্র টাকার সন্ধান পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অপবিত্র টাকার কারণে নাটক কিংবা আটক এ দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে নতুন হলো কিছু পরিসংখ্যান। গণমাধ্যমে প্রকাশিত লাক মিয়া-সংক্রান্ত সংবাদমতে, ‘সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্টে ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার লেনদেন’ হয়েছে। বছরে ৩৬৫ দিন। আর একজন চেয়ারম্যানের ক্ষমতার মেয়াদ থাকে পাঁচ বছর অর্থাৎ (৩৬৫X৫) ১৮২৫ দিন। অন্যদিকে পরপর তিন মেয়াদে (১৮২৫X৩) ৫৪৭৫ দিন তিনি চেয়ারম্যানের চেয়ারে ছিলেন। এখন তার অ্যাকাউন্টে লেনদেনকৃত ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকাকে এই ৫৪৭৫ দিয়ে ভাগ করলে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে আড়াই কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে তার অ্যাকাউন্ট থেকে। এমন লাক কয়জনের হয়, যদি না ব্যাংক, দুদক ও অন্যান্য সবাই বছরের পর বছর নাক ডেকে না ঘুমায়?

ধরা খেয়েছেন আরও এক বড় নেতা । ‘খামু’ ‘খামু’ করা ঝালকাঠির এই নেতারও ব্যাডলাকের কপাল খারাপ। ৫ আগস্টের পর বাড়িতে থাকা কোনো কিছু সরানোর সুযোগ না দিয়েই বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। এতে বাড়িতে থাকা বই-খাতা, কম্বল-কাঁথা, আসবাব সবই পুড়ে যায়। সেইসঙ্গে আরও পোড়ে তোশকের নিচে ও বস্তায় বস্তায় ভরে রাখা দেশ-বিদেশের টাকা। এসব টাকার বস্তা কোনটি আংশিক আবার কোনটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। পরে সরকারি বাহিনী ও অগ্নিনির্বাপণে নিযুক্ত দমকল কর্মীরা আগুন নিভিয়ে টাকার বস্তা উদ্ধার করে। তবে পুড়ে যাওয়া টাকাও কম ছিল না সেখানে। সেই টাকা পুড়ে উৎপন্ন হওয়া ছাই দিয়ে দাঁত মেজেছেন একদল রসিক মানুষ। এরপর পুকুরের পানিতে ছাই-সমেত কুলি করা পানি ফেলে আফসোস করে বলেছেন, ‘ব্যাডলাকের কপাল খারাপ। নেতার সব টাকাই পানিতে গেল!’

পানিতে চলা নৌকা বিগত প্রায় ১৬ বছরে গুডলাকের প্রতীক রূপে বিবেচিত ছিল। কারণ স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ের যে কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা পেলেই জয় ছিল সুনিশ্চিত। নৌকা পেলে ভোট নিয়ে চিন্তা করত না কোনো প্রার্থী। কিন্তু বিপদে পড়ে সেই নৌকা ছেড়ে বিমান, ট্রেন, কার কিংবা পায়ে হেঁটে পালিয়ে ছিলেন সবাই। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন দুজন। একজন আগের আইনমন্ত্রী। আর অন্যজন ছিলেন ডাকসাইটে ও ক্ষমতাধর উপদেষ্টা। এ দুজন শেষ পর্যন্ত নৌকা আঁকড়ে ছিলেন এবং লুঙ্গি পরে মাঝির বেশে নদীপথে পালাতে চেষ্টা করেন। ছদ্মবেশের অংশরূপে একজন আবার তার চিরচেনা সফেদ লম্বা দাড়ি কেটে ক্লিন সেভ অবস্থায় নৌকার বৈঠা ধরেন। তবে ব্যাডলাকের কপাল খারাপ। ক্লিন সেভ করা উপদেষ্টাকে না চিনলেও প্রাক্তন আইনমন্ত্রীকে ঠিকই চিনে ফেলে আশপাশের মানুষ। ফলে কট হন সেই দুজন।

এ নিয়ে দুষ্ট পোলাপান আবার আরেক গল্প ফেঁদেছে। তাদের মতে, গাছের ডালেরটা এবং মাটিতে পড়া সব ফল খেতে অভ্যস্ত উপদেষ্টার কপাল প্রথমে এতটা ব্যাড ছিল না। তাকে নাকি ক্লিন সেভ ও লুঙ্গি পরা অবস্থায় প্রথমে চিনতে পারেনি লোকজন। কিন্তু সঙ্গে থাকা প্রাক্তন মন্ত্রী নাকি ধরা খেয়ে বলেন, ‘আমাকে একা নিচ্ছেন কেন? ওনাকে চেনেন নাই। উনি উপদেষ্টা ছিলেন গত ১৬ বছর। নাম দরবেশ।’ মুহূর্তেই দাড়িবিহীন উপদেষ্টাকে চিনে ফেলে সবাই। একেই বলে ব্যাডলাকের কপাল খারাপ।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাবিতে বহুল প্রত্যাশিত ই-কার সেবা চালু

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ম্যাচের জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী দল ঘোষণা

শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা, অভিযুক্তকে পুলিশে দিলেন স্থানীয়রা

হোয়াটসঅ্যাপে এলো নতুন ‘নোট’ ফিচার

আবারও যমুনা অভিমুখে মিছিলের ঘোষণা ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার্থীদের

ব্যক্তিগত চ্যাট ফাঁসের পর বিয়ে স্থগিত, মুখ খুললেন গায়কের মা

প্রবাসীর স্ত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

হত্যা মামলার প্রধান আসামি র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

লটারির পর একযোগে ৬৪ এসপিকে বদলি

লটারিতে এসপি নিয়োগে মেধাবী কেউ বাদ পড়েনি : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১০

ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নতুন নির্দেশনা

১১

সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে সব বাহিনী প্রস্তুত : সিইসি

১২

দাঁতের জন্য মারাত্মক খারাপ যে ৫ খাবার

১৩

এলিফ্যান্টস ফুট : পাঁচ মিনিট কাছে থাকলেই মৃত্যু

১৪

‘কবর থেকে মানুষ যেমন ফেরে না, শেখ হাসিনাও রাজনীতিতে ফিরবেন না’

১৫

বাংলাদেশে অবাধ-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় জার্মানি

১৬

আ.লীগ নেতাদের বিএনপিতে যোগদান

১৭

ধানক্ষেতে মিলল গলাকাটা বিবস্ত্র মরদেহ, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মুখ

১৮

বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দলকে চায় ভারত

১৯

সাগরে লঘুচাপ, নৌকা ও ট্রলারকে গভীর সাগরে যেতে মানা

২০
X