কৃষ্ণনগর রাজ্যে চোরের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি রাতেই কোনো না কোনো বাড়িতে চুরি হচ্ছে। প্রজারা অতিষ্ঠ, উৎকণ্ঠিত। নালিশ জানাতে তারা হাজির হলো রাজদরবারে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় সব শুনে চিন্তিত হলেন। রাজ্যের বিখ্যাত চোর ‘কেলে পচা’ তো চুরি ছেড়ে দিয়েছে। মন্ত্রীর সাগরেদ দুই চোর ‘বটা আর ঘটা’ও এখন চুরি করে না বলে শোনা যায়। তাহলে এই চোর এলো কোত্থেকে? রাজা ‘ব্যাপারটা দেখছি’ এবং সবাইকে সতর্ক থাকতে বলে প্রজাদের বিদায় দিলেন। সে রাতেই চুরি হলো সেনাপতির বাড়িতে। তারপর মন্ত্রী এবং আমাত্যদের বাড়িতে। উপায় না দেখে রাজা গোপাল ভাঁড়কে বললেন একটা উপায় খুঁজে বের করতে। গোপালের পরামর্শমতো রাজা সারা রাজ্যে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে দিলেন, ‘রাজা কৃষ্ণনগর রাজ্যে চুরির প্রতিযোগিতা আহ্বান করেছেন। আগামীকাল রাতে যে সবচেয়ে বেশি জিনিস চুরি করতে পারবে, তাকে রাজার পক্ষ থেকে পুরস্কার ও ভাতা দেওয়া হবে।’ প্রজারা বিস্মিত! এ আবার কেমন কথা! খেলাধুলার প্রতিযোগিতার কথা তারা শুনেছে। কিন্তু চুরির মতো অপরাধের প্রতিযোগিতা, আর সেজন্য পুরস্কারের কথা বাপ-দাদার জনমেও কেউ শোনেনি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অচিরেই হয়তো রাজাকে বস্ত্রহীন অবস্থায় রাজপথে নাচতে দেখা যাবে। প্রজারা চিন্তিত মনে ঘুমাতে গেল।
সে রাতে রাজ্যব্যাপী বহু বাড়িতে চুরি হলো। ঘোষণা মোতাবেক চোরেরা পরদিন চুরি করা জিনিসপত্র নিয়ে রাজদরবারে হাজির হলো। কেলে পচা এবং বটা-ঘটাও বাদ নেই। তবে পেশাদার চোর কেলে পচা ও বটা-ঘটা খুব বেশি কিছু চুরি করতে পারেনি। কেলে পচা চুরি করে এনেছে গোপাল ভাঁড়ের বাড়ি থেকে কাঁসার একটি থালা ও গ্লাস আর বটা-ঘটা দুজনে এনেছে কিছু হাঁড়িপাতিল। তবে নতুন চোরেরা এনেছে বস্তা বস্তা জিনিসপত্র। বহু চোরের উপস্থিতি দেখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মাথায় হাত। আমার রাজ্যে এত চোর! কোথা থেকে এলো এত চোর? গোপাল ভাঁড় রাজাকে বলল, ‘মহারাজ, আপনি চুরি করার সুযোগ এবং পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়ায় পুরানো চোরের সঙ্গে কিছু নতুন চোরও জুটেছে।’ উপস্থিত চোরেরা বলল, ‘মহারাজ আপনার ঘোষণামতো আমরা চুরি করে জিনিস নিয়ে এসেছি। এখন আমাদের পুরস্কার দ্যান।’ রাজা সেনাপতিকে হুকুম দিলেন, ‘সব কটাকে গারদে ঢোকাও।’ শুনে চোরেরা বলল, ‘এটা কেমন কথা মহারাজ! আপনি ঘোষণা করেছেন, চুরি করতে পারলে আমাদের পুরস্কার ও ভাতা দেবেন। আর এখন পাঠাচ্ছেন জেলে! এ কেমন অবিচার?’ এবার গোপাল ভাঁড় বলল, ‘আরে বেটারা, মহারাজের ওই ঘোষণা ছিল তোদের ধরার ফাঁদ। পুরস্কার তোরা অবশ্যই পাবি। সেটা দেবে সেনাপতি তোদের গারদে ঢুকিয়ে। আর ভাতার বদলে তোরা এখন খাবি জেলের ভাত।’
এটা নিছক একটা গল্প। বাস্তবে এমনটি ঘটে না, ঘটা সম্ভবও নয়। পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে চোর ধরা যায় না। তা ছাড়া পুরস্কারের লোভ দেখালেও কোনো চোর এসে বমাল ধরা দেবে তেমনটি আশা না করাই ভালো। অন্য দেশের কথা বাদই দিলাম। আমাদের দেশে একবার চোরদের মুখ থেকে চুরির স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা হয়েছিল রীতিমতো কমিশন বসিয়ে। স্মরণ থাকার কথা, ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন-মইন ইউর সরকার দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে গঠন করেছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি কমিশন’। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান ছিলেন সে কমিশনের প্রধান। যদিও পরবর্তী সময়ে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই কমিশনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। কমিশনটি ছিল স্বল্পায়ুর। গঠিত হয়েছিল ৩০ জুলাই ২০০৮ তারিখে আর একই বছরের ১৩ নভেম্বর তার বিলুপ্তি ঘটে। ওই কমিশনে ৪৫৬ জন দুর্নীতির, মানে চুরির স্বীকারোক্তি দিয়ে ৩৪ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছিল। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছিল, দুর্নীতিবাজরা যে পরিমাণ অর্থ চুরি করেছে, তার অতি ক্ষুদ্রাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে ‘দায়মুক্তি সনদ’ নিয়েছে। এ যেন মনুষ্য মলের ডোবায় অবগাহনের পর সুগন্ধি সাবান দিয়ে ঘষেমেজে গোসল করে ঝরঝরে হয়ে যাওয়া। পদক্ষেপটি যে দেশ থেকে দুর্নীতি অর্থাৎ চুরি নির্মূল বা দমনের জন্য মোটেও কার্যকর ছিল না, তা বলাই বাহুল্য।
কৃষ্ণনগর রাজ্যের রাজা চোর ধরার জন্য চুরির প্রতিযোগিতা আহ্বান করেছিলেন। আর আমাদের দেশে পুরস্কারের আশায় নয়, এমনিতেই সদা-সর্বদা চুরির প্রতিযোগিতা চলে। সরকারি অফিস-আদালত, নির্মাণকাজ, ব্যাংক-বীমা এমনকি শিক্ষাঙ্গনেও চুরির প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। কে কত অবৈধ আয় করে সম্পদের পাহাড় গড়তে পারে, তার এক অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে। সরকারি অফিসগুলোর পিয়ন থেকে সর্বোচ্চ কর্তা অবধি এ প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে বসে আছেন। এ যেন অনির্দিষ্ট দূরত্বের দৌড় প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার জোয়ার এসেছিল গত বছর গতায়ু হওয়া সরকারটির আমলে। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত চলেছে চুরির মহোৎসব। কে নাম লেখাননি সে প্রতিযোগিতায় সেটাই এখন গবেষণার বিষয়। সরকারের প্রধান নির্বাহী ও তার স্বজন-সুহৃদ, সঙ্গী-সাঙাতদের সেসব কীর্তির কিছু কিছু সে সময় ইশারা-ইঙ্গিতে প্রকাশ পেলেও থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে তাদের বিদায়ের পর। এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতায় থাকতে ক্ষমতাধরদের অপকীর্তির কথা প্রকাশ করার ক্ষমতা কারইবা থাকে? কেননা দেহে তো মস্তক একটাই। সুতরাং সবাই তখন ‘চুপচাপ দেখো এবং মনে রাখো’ নীতি অবলম্বন করেছিল। এখন সেসব চুরির কাহিনির গুহার দ্বার চিচিং ফাঁক হয়ে খুলে গেছে। আর ফাঁক হওয়া সে ফাঁকা দিয়ে এমন সব তথ্য জনসমক্ষে এসে হাজির হচ্ছে, ইচ্ছে করে ‘এ যে দেখছি কানার হাটবাজার’ গানের অনুকরণে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠি—‘এ যে দেখছি চোরের হাটবাজার।’
১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি সিনেমা ‘ভাই ভাই’য়ে লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া একটি গান আছে— ‘ইস দুনিয়া মে সব চোর চোর হ্যায় / দুনিয়া মে সব চোর / কোই পয়সা চোর, কোই মুরগি চোর, কোই হ্যায় দিল কা চোর /...কোই চোরি করে খাজানে কি, কোই আনি ইয়া দু’আনি কি / কোই ছোটা চোর কোই বড়া চোর / কোই বয়ঠা চোর কোই খাড়া চোর / দুনিয়া মে সব চোর..’। মানে এই দুনিয়ায় সবই চোর। কেউ পয়সা চোর, কেউ মুরগি চোর, কেউ খাজানে মানে ভান্ডার লুটে, আবার কেউ আনা-দু’আনা চুরি করে। গানটির কথা সর্বাংশে হয়তো সঠিক নয়। কেননা, দুনিয়ায় সবাই যদি চোর হতো তাহলে এ দুনিয়া আর দুনিয়া থাকত না। রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ত, সমাজ ছেয়ে যেত অরাজকতায়। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রবাদটি রূপ নিত বাস্তবে। এখনো কিছু ভালো মানুষের অস্তিত্ব আছে এই সমাজে; যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সততার ঝান্ডা উঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন অসৎ, দুর্নীতিবাজ তথা চোরদের বিরুদ্ধে। সমস্যা হলো তারা প্রায় সঙ্গীহীন। চারদিকের চোরের মহাসমাগমে তারা একেবারেই অসহায়।
আচ্ছা, ঘরে সিঁধ কেটে চুরি আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ লোপাট বা ব্যাংক ফোকলা করে বিদেশে অর্থ পাচারের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? যারা সিঁধ কেটে চুরি করে তাদের আমরা বলি ছিঁচকে চোর আর যারা রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুট করে তাদের আখ্যায়িত করি দুর্নীতিবাজ, লুটেরা। সবচেয়ে মর্মযাতনার বিষয় হলো, ছিঁচকে চোরেরা সমাজে পরিত্যক্ত বিবেচিত হয় আর বড় চোরেরা কেউকেটা সেজে সমাজে মাথা উঁচিয়ে চলে। কখনো কখনো তারা হয়ে যায় নরপতি বা জনপ্রতিনিধি। এজন্যই বোধকরি ‘মারো তো গন্ডার, লুটো তো ভান্ডার’ প্রবাদটির উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ কারোরই অবিদিত নয়। জানোয়ার মারলে অতিকায় গন্ডারকে মারো। আর যদি লুটতে হয়, মানে চুরিই করো তবে ছোটখাটো নয়, একেবারে ভান্ডার লুট করো। ভান্ডার লুটলে সুবিধা আছে। এর একটি অংশ ব্যয় করে মানুষের মুখ যেমন বন্ধ করা যায়, আবার সমাজে কল্কেও পাওয়া যায়।
আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামে একসময় এক বিখ্যাত চোর ছিল। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যন্ত তার চুরির প্রবল দাপট ছিল বিক্রমপুরের পশ্চিমাঞ্চলে। থানা-পুলিশের সঙ্গেও ছিল তার দহরম-মহরম। কোথাও কোনো চুরির ঘটনা ঘটলেই ডাক পড়ত তার। সে বা তার সাগরেদরা কেউ চুরি করলে হতো একভাবে রফা আর না করে থাকলে সে সন্ধান দিত কারা কাজটি করেছে। ধরুন তার নাম ছিল কফিলউদ্দিন, সবাই ডাকত ‘কইফ্ফা চোরা’। আমাদের পাশের গ্রাম বাসাইলভোগে ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিলের একসময়ের প্রেসিডেন্ট এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি সৈয়দ আবদুল মান্নানের বাড়ি। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মীর সাব’ নামে। একবার মাদারীপুরের শিবচর থেকে আসা সৈয়দ সাহেবের এক মেহমান আমার মেজো ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবাজি, মীর সাবের বাড়িডা চিন নি?’ আমার মেজো ভাই জবাব দিলেন, ‘কী যে কন! এই এলাকায় মান্নান মীর আর কইফ্ফা চোরারে না চিনে কে?’ মেহমান গিয়ে সৈয়দ সাহেবকে কথাটা বললেন। মেহমানের বর্ণনা শুনে তিনি বুঝে ফেললেন এটা কার কম্ম। তিনি বললেন, ‘ওই বান্দরটা আমার নাতি। কিছু মনে করবেন না।’ পরদিন আমার মেজো ভাই যখন শ্রীনগর বাজারে সৈয়দ সাহেবের গদিঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি ডেকে বললেন, ‘কী নাতি আমার বিয়াই বাড়ির লোককে কী বলছ?’ মেজো ভাই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নানা ভাই আমি তো মিথ্যা বলি নাই। লোকজন আপনারে চিনে ভালো মানুষ হিসাবে আর কইফ্ফা চোরারে চিনে চোর হিসাবে।’ নাতির জবাবে নানা সন্তুষ্ট।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠনকারীদেরও মানুষ চিনে রাখবে। তারা যতই ভালো মানুষ সাজুক, এঘাট সেঘাট ম্যানেজ করে অপকর্ম ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করুক, পৌত্র-পৌত্রাদিক্রমে তারা পরিচিত হবে চোরবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন