শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিনে শোকে মুহ্যমান ছিল গোটা জাতি। সুপ্রশস্ত মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। রাজধানী ঢাকা সব পথই সেদিন মিশে গিয়েছিল এক মোহনায়। শহীদ জিয়ার লাশ আনা হয়েছে জানাজায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটেছে। সবার চোখে কান্না, হৃদয়ে শোকানুভূতি। বিপথগামী সেনাসদস্যরা ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তার মৃতদেহ সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৭ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশে পাহাড়ের ঢালুতে কবর দেয়। হত্যাকারীরা ওই কবরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আরও রাখে ঘটনায় নিহত কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ রাখা হয় ওই দুই সেনা অফিসারে মাঝে। ১ জুন বেলা ১১টায় জিয়াউর রহমানের লাশ তোলা হয়। ওইদিন বিকেল পৌনে ৪টায় বিমানবাহিনীর একটি বিমানে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। এ সময় গোটা শহরজুড়ে এক বেদনাঘন শোকার্ত পরিবেশে সৃষ্টি হয়। বিমানবন্দর থেকে জিয়াউর রহমানের লাশবাহী কফিনটি একটি সামরিক যানে সেনাবানিবাসের রাষ্ট্রপতি ভবনে আনা হয়। এ সময় সেনানিবাসের ১ নম্বর গেট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বিমানবাহিনীর সদস্যরা শ্রদ্ধাবনতভাবে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। আর গেটের বাইরে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। কফিনটি রাষ্ট্রপতি ভবনে আনার পর এখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। খালেদা জিয়া, তাদের দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান, আত্মীয়-পরিজন এবং অপেক্ষমাণ লোকজন সবাই কান্নায় ভাঙে পড়েন। বিকেল ৫টায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিন সংসদ ভবনে নেওয়া হলে সেখানেও তার মৃতদেহ একনজর দেখার জন্য শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণের দেখার সুবিধার জন্য এদিন (১ জুন) রাতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ফলে রাত ৯টা পর্যন্ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ দেখার জন্য পুরোনো জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। মানুষের ঢলে এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, মহাখালী রেলগেট, বাংলা মোটর এলাকা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এসব এলাকা ও আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাতে মহিলা, গৃহিণী এমনকি শিশুরা পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের লাশ একনজর দেখার জন্য ভিড় জমায়। পরদিন ২ জুন বেলা ১১টা পর্যন্ত কফিনটি তেজগাঁও সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রাখা হলে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেখানে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অগণিত মানুষ শহীদ জিয়াকে শেষবারের মতো একনজর দেখেন। এদিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দাফন সম্পন্ন হয়। এসব খবর ওই সময়ের দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্রিকা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে।
২ জুন দৈনিক আজাদ ‘একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ’ শিরোনামের খবর আট কলাম জুড়ে প্রকাশ করে। আর দৈনিক ইত্তেফাক এদিন ‘ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ: অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ এবং ‘রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জিয়ার লাশ চাপা দেওয়া হয়’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। এর পরদিন অর্থাৎ ৩ জুন দৈনিক আজাদ প্রধান খবর হিসেবে
‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান
পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ দাফন’—শিরোনামে আট কলামে প্রকাশ করে।
দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত দুটি রিপোর্ট হুবহু তুলে ধরা হলো:
রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জিয়ার লাশ চাপা দেওয়া হয়
বিশেষ প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম, ১লা জুন: চট্টগ্রাম শহর হইতে ১৭ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশে পাহাড়ের ঢালু পাদদেশে একটি কবর হইতে আজ সকাল ১১টায় শনিবার ভোরে নিহত জিয়াউর রহমানের লাশ তোলা হইয়াছে। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশের সহিত একই কবরে প্রেসিডেন্টের লাশ চাপা দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্টের লাশ ছিল অপর দুইজনের মাঝে। কাফনের অভাবে ত্রিপলে জড়াইয়া লাশ তিনটি প্রোথিত হয়। সেই রক্তাক্ত ত্রিপলও আজ খুঁড়িয়া বাহির করা হইয়াছে।
হত্যাকারীরা পাহাড়তলী বাজার হইতে তালেব আলীসহ আরো দুইজন লোককে লইয়া গিয়া শনিবার সকালে উক্ত কবর খোঁড়ায়। তাহাদের প্রতি জনকে ২৫ টাকা হারে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। স্থানীয় মাজার হইতে একজন মৌলভীকে ১০০ টাকা বিনিময়ে আনিয়া জানাজা পড়ানো হইয়াছিল। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিনজন ছাত্র কোতোওয়ালী থানায় রিপোর্ট করিলে প্রেসিডেন্টের লাশ উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাহাড়ের পাদদেশবর্তী কবরের স্থানটিকে স্থানীয় জনসাধারণ আজ সাদা কাপড়ে ঘিরিয়া দিয়াছে। সেখানে কোরান তেলাওয়াত চলিতেছে। (দৈনিক ইত্তেফাক: ২ জুন মঙ্গলবার ১৯৮১)
ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ: অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি
(ইত্তেফাক রিপোর্ট)
এক বেদনাঘন শোকার্ত পরিবেশে গতকাল (সোমবার) চট্টগ্রাম হইতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ ঢাকায় আনয়ন হয়। নিহত প্রেসিডেন্টকে একনজর দেখার জন্য সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে মানুষের ঢল নামে।
গতকাল (সোমবার) অপরাহ্ণ পৌনে ৪টায় চট্টগ্রাম হইতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মরদেহের কফিন লইয়া বিমান বাহিনীর একটি বিমান কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করিয়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কফিনটি শ্রদ্ধাসহকারে গ্রহণ করেন। বিমান হইতে কফিনটি বিমান বাহিনীর সদস্যগণ একটি খোলা সামরিক যানে উঠাইয়া নেন এবং কফিনটি পুষ্পস্তবকে সজ্জিত করা হয়। কফিনের সহিত বিমানে বিএনপির সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মহিবুল হাসান, উপমন্ত্রী মিসেস কামরুন্নাহার জাফর এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ডক্টর মিসেস আমিনা রহমান আগমন করেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে শোকে মুহ্যমান দেখা যাইতেছিল।
প্রেসিডেন্টের কফিনটি লইয়া সামরিক যানটি সেনানিবাসের প্রেসিডেন্ট ভবনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করিলে বিমান বাহিনীর সদস্যগণ ‘গার্ড অব অনার’ প্রদর্শন করেন। সেনানিবাসের ১ নং গেইট হইতে প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত রাস্তার দুই পার্শ্বে বিমান বাহিনীর সদস্যগণ শ্রদ্ধাবনতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া সম্মান দেখান। এই সময় ১ নং গেইটের বাহিরে হাজার হাজার মানুষ প্রতীক্ষাকুলভাবে দাঁড়াইয়াছিলেন।
কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে লইয়া যাওয়ার পর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বেগম জিয়াউর রহমান, তাঁহাদের দুই পুত্র, আত্মীয়পরিজন এবং অপেক্ষমাণ লোকজন সকলেই কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন।
সংসদ ভবনে জনসাধারণের দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশের কফিনটি গতকাল অপরাহ্ণে সাড়ে ৫টায় সংসদ ভবনের সম্মুখে লইয়া আসা হয়। সেখানে প্রথমে সংসদ সদস্যগণ শোকাহত চিত্তে কফিনের সম্মুখে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রেসিডেন্টের মরদেহ আনার খবর রাজধানীতে ছড়াইয়া পড়িলে এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এয়ারপোর্ট রোডে অগণিত লোক রাস্তায় নামিয়ে আসেন। পুলিশ শোকাহত লোকজনকে সারিবদ্ধ করার চেষ্টা করে। বাংলামোটর হইতে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া যায়। আগামীকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত কফিনটি সংসদ প্রাঙ্গণে রাখা হইবে। জনসাধারণের দেখার সুবিধার্থ গতরাতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়।
সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়, রাত্রি নয়টা পর্যন্ত নিহত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশ দেখার জন্য জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে প্রচণ্ড ভিড় পরিলক্ষিত হয়। কফিন রাখা জায়গার দিকে মানুষের লাইন এয়ারপোর্ট রোডের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়িয়া আগাইতেছিল। একদিকে ফার্মগেট এবং অন্যদিকে মহাখালী রেলগেট পর্যন্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এই সকল ও আশেপাশের এলাকায় মানুষের ভিড় অঘোষিত মিছিলের মতো পরিলক্ষিত হয়।
রাত্রে পর্যন্ত মহিলা, গৃহিণী এমনকি শিশুদের পর্যন্ত ভিড় করিতে দেখা যায়। সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দীন হোসেন, আওয়ামী লীগের (মিজান) জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, মসলিম লীগের খান এ সবুর, জাসদের মেজর (অব.) এম এ জলিল, জনাব আ. স. ম. আবদুর রব, জনাব শাজাহান সিরাজ, একতা পার্টির সৈয়দ আলতাফ হোসেন, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের জনাব সিদ্দিকুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির জনাব নাসিম আলী গতকাল সন্ধ্যায় সংসদ ভবনের সম্মুখে শায়িত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কফিনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। (দৈনিক ইত্তেফাক: ২ জুন, মঙ্গলবার ১৯৮১)
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন