ভোটাধিকার ছারখার করা সরকারটির পতনের ১০ মাস পর বিতর্কিত নির্বাচনের হোতাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের গরজ করল সরকার। তাও বিএনপির এক নেতার মামলা করার পর। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বিএনপি বা কারও মামলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো কেন? এ প্রশ্নের জবাব কিন্তু উহ্যই থেকে গেল। তারপরও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থা বরবাদের ফ্রন্টের দুই ভাঁড়কে কয়েদ করার মাধ্যমে। তাদের আরেকজন এখনো অধরা। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ‘শতভাগ ভোট’ কাস্ট হওয়া কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। ভোট কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের তথ্য পেতে ইসিতে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি পাতানো নির্বাচনে প্রভাবশালীদের তথ্যও চেয়েছে দুদক। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জেতাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কদাকার অপব্যবহারে জড়িত ছিলেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও।
এরই মধ্যে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আছেন আরেক কাজী, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। তিন তামাশার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্তে সরকার একটি কমিটিও করেছে। পাঁচ সদস্যের এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে। কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব শামীম আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক, আইনজীবী তাজরিয়ান আকরাম হোসাইন এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম। কমিটিকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে। কমিটি তদন্তের প্রয়োজনে আরও সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে।
২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক, দেশি ও বিদেশি তদারকি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠনের প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমে উত্থাপিত অভিযোগ বিশ্লেষণ করবে এ কমিটি। নির্বাচনের বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এবং সার্বিকভাবে এগুলোর নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করবে। এসব নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ করতে ও জনগণের ভোটাধিকার বাধাগ্রস্ত করতে তখনকার ক্ষমতাসীন দল ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা বিশ্লেষণ, তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এবং এর সচিবালয় ও প্রশাসনের ভূমিকা বিশ্লেষণ, নির্বাচন কার্যক্রমে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা বিশ্লেষণ করবে। নির্বাচন কমিশনগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবে।
গত অর্ধশত বছরে ভোটের বহু মডেল প্রদর্শন হয়েছে বাংলাদেশে। এখানে গণতন্ত্রের বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েকদলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনেরও এন্তার রকমফের! নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট, হ্যাঁ-না ভোট। সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপিরও নানান কলসাইন। মাগুরা, মিরপুর, ১৫ ফেব্রুয়ারি, বিনা ভোট, রাতের ভোট ইত্যাদি। সালশা নির্বাচন নামও আছে। এখন সামনে অপেক্ষা করছে কোন মডেল, তা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়।
স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচনেই আচানক মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ওই মডেল ভোটের জন্য আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। খাসপছন্দের খন্দকার মোশতাককে (পরবর্তী নাম খুনি মোশতাক) জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকা এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এরপর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, আওয়ামী লীগকে নৌকা-মই ইত্যাদি চার ভাগে সিট বণ্টনসহ নানা মডেল শো। এ শোতে আরও নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদ জমানায়। নির্বাচনের এই সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর ৯১-তে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। তবে ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়া আজকের ক্ষমতাসীনদের কাছে সেটি ছিল সূক্ষ্ম কারচুপির মডেল। এর মাঝেই গণ্ডগোল পাকে তখনকার বিএনপি সরকারের মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনী মডেলে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দীনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনী নাশকতা। হতে হতে ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ।
এর আগে, ২০১৪ সালে বিনাভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড। যারা এখন মডেল নির্বাচনের ওয়াদা শোনাচ্ছেন তারা একবারও বলছেন না ১৪ বা ১৮ সালের মডেলটি ঠিক ছিল না। বরং ১৫৪ জনকে বিনা ভোটে পাসের পক্ষে জোরালো যুক্তি তাদের। ২০১৮ দিনের ভোট রাতে এবং ২৪ সালে এসে যোগ হয় ডামি-আমি মডেল। নুরুল হুদা গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিলেন, এবার আর দিনের ভোট রাতে হতে দেওয়া হবে না। তার আগেরজনের অঙ্গীকার ছিল ১৮ সালে ১৪ সালের মতো বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে পাস করতে দেবেন না তিনি। কথা রেখেছেন, বিনা ভোটে এমপি হওয়া কমিয়েছেন। কিন্তু ভোট রাতে এগিয়ে এনেছেন। আশা বা ধারণা করা যায়, ২৪-এর নির্বাচনে বর্তমান সিইসি তার ওয়াদামতো রাতের ভোটের রেকর্ড ভাঙবেন, ভোটের কাজটি দিনেই করাবেন-করবেন। বাস্তবতা অন্যরকম। কাজী হাবিবুল আউয়াল দিনের ভোট রাতে করেননি। বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে এমপি বানাননি। তিনি দেখিয়েছেন আমি-ডামির সার্কাস। এর মাঝে উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনী মডেলের হালকা ছাপ দেখেছে বাংলাদেশ। উত্তর কোরিয়ায় অল্প খরচে সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়। হানাহানি হয় না। কারচুপি-জালিয়াতির প্রশ্ন ওঠে না। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিম পরিবারের বংশ পরম্পরায় শাসন করা দেশটিতে ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি অবাধে, অংশগ্রহণমূলকভাবে আনুগত্য দেখায়। সেখানকার জনগণ, প্রশাসনসহ সবমহল এতে অভ্যস্ত।
পাঁচ বছর পরপর সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সুশৃঙ্খলভাবে তারা ভোট দেয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই ভোটকেন্দ্রে চলে যায়। দাঁড়িয়ে যায় বিশাল লম্বা লাইনে। ভোট দিয়ে চলে যায় না। কেন্দ্রের সামনে সবাই মিলে আনন্দ করে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে বলে স্লোগান দেয়। সেই যাত্রায় আর এগোনো হলো না বাংলাদেশের। চব্বিশের ৫ আগস্ট না ঘটলে হয়তো সামনে তাও দেখা যেত। একটু দেরিতে হলেও নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসের হোতারা এখন বিচারের অধীন। দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে ব্যাংক খাত ধ্বংসের ফ্রন্টের শিরোমণিরা এখনো অধরা। ওই ষাঁড়দের ধরতেও কি কারও মামলা ঠোকা লাগবে?
১৫ বছরের শাসনামলে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে তামাশা করা, ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণ ডাকাত গোষ্ঠীর হাতে সঁপে দেওয়া, অর্থ পাচারে অনবদ্য ভূমিকা রাখা তিন গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আবদুর রউফ তালুকদাররা দিব্যি জবাবদিহির বাইরে। গেল সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের মে মাসে গভর্নর করে অধ্যাপক আতিউর রহমানকে। নিজেকে রাখাল বালক, গরিব ঘরের সন্তান প্রচার করে দেশে একটি অন্যরকম হাইপ তুলতে সক্ষম হন তিনি। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং যাকে বলে। সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ হ্যাক তার সময়েরই কীর্তি। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ নয়টি নতুন ব্যাংক অনুমোদনের ঘটনাও ঘটে তার আমলে। আত্মপ্রচারে উৎসাহী এ সাবেক গভর্নর রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটার পর ২০১৬ সালে পদত্যাগ করেন। এরপর আসেন সাবেক অর্থ সচিব ফজলে কবির। দখল ও লুটপাটের বৈধতা দেওয়ায় তিনি আরও ক্যারিশমা দেখান। ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক বেসরকারি ব্যাংক এস আলমের দখলে নেওয়ার বন্দোবস্তে তার অপরিসীম অবদান। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সর্বোচ্চ ৬৫ বয়স পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। ফজলে কবিরের জন্য সে আইন সংশোধন করে বয়স বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়।
তার জমানার পর ২০২২ সালে আসেন আবদুর রউফ তালুকদার। টাকা ছাপানোর গভর্নর নামে যশখ্যাতি ছড়ানো এ তালুকদারের সময় অর্থ পাচার আরও ব্যাপকতা পায়। লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোর ঘাটতি মেটাতে তিনি টাকা ছাপার ক্যারিশমা দেখান। সেই টাকাও ফের ঋণের নামে তুলে নেয় এস আলম গ্রুপসহ আওয়ামী লীগের খাসপছন্দের লোকেরা। সেই টাকাও পাচার করে দেওয়া হয়। তার আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং আর্থিক তথ্য গোপন রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর তিনি আত্মগোপনে যান। বাংলাদেশে সরকার পতনের পর গভর্নরেরও পালানোর ইতিহাসের পত্তন করেন তিনি। ধরাছোঁয়ার বাইরে তার আগের দুজনও। ব্যাংক দখল, অনিয়ম ও অর্থ পাচারে এই গভর্নরদের কাউকে এখন পর্যন্ত আইনি জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণে ব্যাংক খাতের সংস্কারে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টি উহ্যই থাকবে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কারের কোনো পদক্ষেপও কি নেওয়া হবে না?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন