দুনিয়া কাঁপানো ৫ আগস্ট আজ। বাংলাদেশের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসা ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হয় এই দিনে। হতাশ ও ক্ষুব্ধ জনগণ অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছিল বছরের পর বছর। পতনের কিছুদিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সংগঠিত হয় গণঅভ্যুত্থান। টানা ৩৬ দিনে সেটি সুনামির রূপ নেয়। দেড় দশকের পরাক্রমশীল আওয়ামী লীগ সরকার খড়কুটোর মতো ভেসে যায় উজানে থাকা ভারতে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় জান বাঁচাতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পরিবারের সদস্যদেরও নিরাপদে পালানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। মুহূর্তে ধসে যায় নিশ্ছিদ্র মাফিয়াতন্ত্র। সুবিধাভোগী আমলাতন্ত্র, কমিশন খাওয়া শৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যবসায়ীর নামে লুটেরা শ্রেণি ও ধামাধরা সুশীল সমাজের আনহোলি অ্যালায়েন্স এলিয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। পুলিশের সহযোগী হিসেবে কুখ্যাত ছাত্রলীগ-যুবলীগের হেলমেট বাহিনী নিমিষেই গা-ঢাকা দেয় অশরীরী আত্মার মতো। লাখো মানুষ বিজয়োল্লাস করে ‘গণভবন’ নামের ‘স্বৈরদুর্গে’। বাদ যায় না সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও। পরে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী নেতা ও রাজনৈতিক দলগুলো মিলে গঠন করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর হিসেবে বিবেচিত হবে ২০২৪ সাল। গত সাড়ে তিন দশকে দ্বিতীয়বারের মতো অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্দোলনের মুখে ক্ষমতায় থাকা কোনো সরকারপ্রধানের দেশত্যাগ এটাই প্রথম। টানা চারবারের প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রীর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বিশ্ব গণমাধ্যমে তখন প্রধান শিরোনাম হিসেবে স্থান পায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। নিউইয়র্ক টাইমস খবর প্রকাশ করে ‘বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের নেত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন’ শিরোনামে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর জনগণ গণভবনে প্রবেশ করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির সামনে জনতার ক্ষোভ প্রকাশের দৃশ্যও উঠে আসে তাদের প্রতিবেদনে। বিবিসি বলে, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, আন্দোলনকারীরা গণভবন দখল করেছে।’ আলজাজিরার শিরোনাম ছিল, ‘সামরিক হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা, গণভবনে ঢুকে পড়েছে হাজারও মানুষ’। শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার বিষয়টি সব পত্রিকার শীর্ষ শিরোনামে ‘পলায়ন’ বলে লেখা হয়েছিল। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছিল, ‘Sheikh Hasina Flees, Army In Charge’। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের শিরোনাম ছিল, ‘Hasina falls, flees, Army takes Dhaka’। দ্য হিন্দু শীর্ষ খবরটির শিরোনাম দিয়েছিল, ‘Hasina quits, flees Bangladesh, lands in India as protests surge’। হিন্দুস্তান টাইমসের শিরোনামও অনেকটা একই ধরনের। তারা লিখেছিল, ‘Hasina Flees Bangladesh’.
অবশ্য কয়েক দিন বাদেই ভারতের গদি মিডিয়াগুলো বাংলাদেশ ও ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করে। শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী, আন্দোলনকারীদের জঙ্গি হিসেবে উল্লেখ করে তারা। বাস্তবতা ভুলে ক্ষোভের আগুনে অপসাংবাদিকতা শুরু করে। অথচ কীসের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান সফল হয়েছে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। কোটি জনতার অভ্যুত্থানে মুক্তিকামী মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শিক্ষার্থী-নারী-শিশু-শ্রমজীবীসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার। হাজার হাজার লোক পঙ্গু ও শত শত মানুষ অন্ধ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে। আন্দোলন দমাতে মরণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশ স্বয়ং শেখ হাসিনা দিয়েছেন। এটা এখন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে প্রমাণিত। ক্ষমতা টেকাতে দানবে পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। পেটুয়া এবং দলীয় বাহিনী বানানোর ফলে পুলিশের অনেক সদস্যের জীবন গেছে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে। রাষ্ট্র এবং জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ক্ষমতালোভী হাসিনা সরকার। নিষ্ঠুরতার জন্য শেখ হাসিনা ‘লেডি হিটলার’ হিসেবে স্থান পেয়েছেন সমসাময়িক ইতিহাসে। শিশুদের আন্দোলন দমাতে ইসরায়েলের গাজানীতি প্রয়োগ করেছেন তিনি। গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচারী থেকে ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্টে রূপান্তরিত হন এই মুজিবকন্যা। অতি আত্মবিশ্বাস অহমিকার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায় তাকে।
যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখাই স্বৈরাচারী সরকারের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য। ফ্যাসিস্ট হচ্ছে তার চেয়েও কয়েক ধাপ ওপরে। তারা শুধু ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়। তারা চায়, তাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে হবে সবাইকে। দেশের সব মাধ্যমের জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাদের আদর্শের অনুসারী হবে। না হলে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হবে ওইসব ব্যক্তিকে। প্রয়োজনে ইতিহাস পাল্টাতেও দ্বিধা করে না ফ্যাসিস্টরা। গত দেড় দশক ধরে ২০২৪-এর আজকের দিন পর্যন্ত শেখ হাসিনা সে চেষ্টাই করে গেছেন। দেশের ইতিহাস ও উন্নয়নকে পারিবারিক অবদান এবং সম্পদ বলে গণ্য করতেন। গণমানুষের ইতিহাস ও অবদানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন তিনি। রোষানল থেকে বাঁচতে এবং নিজের আখের গোছাতে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরাও মোসাহেবি করতেন। দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বুদ্ধিজীবীরা ওই আফিম খেয়ে তাদের মেধা ফ্যাসিস্টের পদতলে জমা রেখে বৈষয়িক বিষপান করেছেন দেদার। কিন্তু এসব করে কোনো দিন কোনো ফ্যাসিস্ট শেষ রক্ষা পায়নি। মানুষ শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ায়। বিস্মৃতির আড়ালে সবাইকে ঠেলে দেওয়া যায় না। প্রখ্যাত চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা তার ‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ উপন্যাসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পক্ষ থেকে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করে লিখেছেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’
হাসিনা রেজিমের দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে গুম-খুন-অপহরণের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারকে। গত জুলাই-আগস্টে সরকারি নৃশংসতা হিটলারের নাৎসি বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। সেই পরিস্থিতির দগদগে ঘা শুকানোর আগেই পরদেশে আশ্রিতা হাসিনা চট করে স্বদেশে ঢুকে পড়বে বলে ভয় দেখায় বাংলাদেশিদের। তার চালু করা ভয়ের সংস্কৃতির ওপর এখনো ভরসা রাখেন তিনি। কয়েকশ হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় খুনের লাইসেন্স পেয়েছেন বলে উপহাস করেন। রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানকে জঙ্গি তৎপরতা বলে স্বভাবসুলভভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। দেহ-মনে সম্পূর্ণ ফ্যাসিস্ট চরিত্রের না হলে এমনটা পারতেন না। শত শত কচি প্রাণ হত্যার পরও কোনো অনুশোচনা নেই তার। বিশ্বের অন্যান্য ফ্যাসিস্টের মতো তিনিও হয়তো সাইকোপ্যাথ। ভবিষ্যতে তার মস্তিষ্ক গবেষণার দাবি উঠতে পারে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এখন পর্যন্ত তার কোনো অনুসারীকেও অনুতপ্ত হতে দেখা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শত শত সাইটে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। তারা আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করবে বলে ঘন ঘন বার্তা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীকে হয়তো অনুসরণ করছে আওয়ামী লীগ। একাত্তরকে পাশ কাটিয়ে দিব্যি করে কেটে খাচ্ছে জামায়াত। কিন্তু চব্বিশকে পেছনে ফেলে সামনে এগোতে চাইলে আরও দুঃখজনক পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে আওয়ামী লীগকে।
তার চেয়েও দুঃখজনক অভ্যুত্থানকারীদের বর্তমান পরিস্থিতি। দীর্ঘ ১৭ বছরের আন্দোলনে হাজার হাজার নেতাকর্মী খুন হয়েছে বিএনপির। লাখ লাখ মামলায় বিপর্যস্ত তাদের জীবনসংসার। গুম-অপহরণের ট্রমা কাটেনি আজও। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যাবে দলটি। বিএনপির শত্রু-মিত্র সবাই এ কথা জানে। আর এ কারণেই অভ্যুত্থানের অন্য শরিকরা নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে। এ কথা সব জায়গায় উচ্চারিত হচ্ছে। ইউনূস সরকার আগে ছোট বা বড় সংস্কারের কথা বলত। এখন বলছে গভীর সংস্কার। এ নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র দেখছে গণতন্ত্রকামী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দলগুলো। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বীরত্ব নিয়ে গর্ব করে সব মানুষ। তাই বলে তো তাদের রাজনৈতিক দলের অনুসারী হবে না সবাই। অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমানতালে খেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এনসিপির প্রতি ঝুঁকে থাকার অভিযোগ জোরালো হচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনে অনৈক্যের দৈত্য বেশ কার্যকর। সবাই কেমন অটল, অজেয় মনোভাব নিয়ে খানাপিনা করছে। এসব দেখে সাধারণ নাগরিক বিভ্রান্ত। দেশ কি ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে? নিজের মত প্রতিষ্ঠায় মব সৃষ্টি করা তো ফ্যাসিবাদ। গণঅভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় জীবনবাজি রাখা শিক্ষার্থীদের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ ভালো কথা নয়। মজলুম বিএনপির কিছু নেতার আওয়ামী আচরণও সঠিক মনে করছে না মানুষ। বাকস্বাধীনতা ফিরেছে বলে সম্পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগের গুরুত্বহীন সমর্থকরা। আর গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ এখনো ভয় পায় ঝেড়ে কাশতে। এই স্বাধীনতা তো অস্বস্তিকর। অন্তর্বর্তী সরকারকে এনজিও, প্রবাসী, জামাতি-বামাতি নানা নামে ডাকা হচ্ছে। এটারও একটা সুরাহা হওয়া দরকার। কাজের কারণে নাম মহিমান্বিত হয়। সত্যিকারের গণমানুষের সরকার এখন বড় বেশি দরকার।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন