৫ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর সারা দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি নতুন প্রত্যাশার জন্ম হয়েছিল। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন এখন সময়ের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম যে, এ আন্দোলন শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও উন্নয়ন লক্ষণীয় নয়।
বিশেষ করে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অবকাঠামোগত ঘাটতি, পর্যাপ্ত মানবসম্পদের অভাব, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষাদান ও গবেষণার অভিজ্ঞতার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্বল একাডেমিক পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তির অপ্রতুল ব্যবহার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গবেষণায় উদ্ভাবন, শিক্ষায় দক্ষতা ও শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে প্রবেশের বাস্তব প্রস্তুতি নিশ্চিত করা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে একটি সুসংগঠিত, স্বচ্ছ এবং ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো প্রয়োজন। বিশেষ করে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অবকাঠামোগত ঘাটতি, পর্যাপ্ত মানবসম্পদের অভাব। এ প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষাকে আধুনিক, গুণগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে কিছু বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
১. উচ্চগতির ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি-সক্ষম ক্যাম্পাস:
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা একটি অপরিহার্য উপাদান। অনলাইন রিসোর্স ও টেকনোলজিনির্ভর পদ্ধতির জন্য প্রতিটি বিভাগে উচ্চমানের ওয়াইফাই ও কম্পিউটার ল্যাব থাকা জরুরি। প্রযুক্তি-সক্ষম শ্রেণিকক্ষ, স্মার্ট বোর্ড ও মাল্টিমিডিয়া টুলস ব্যবহার করে শিক্ষাদান আরও আকর্ষণীয় ও ফলপ্রসূ করা সম্ভব। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. আধুনিক স্টুডেন্ট ইনফরমেশন সার্ভিস (SIS):
শিক্ষার্থীদের ভর্তি, ফলাফল, আর্থিক লেনদেন ও প্রশাসনিক তথ্য ডিজিটালভাবে সংরক্ষণের জন্য SIS চালু করা আবশ্যক। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য নির্দিষ্ট ইমেইল আইডি থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব তথ্য সেই মাধ্যমে আদান-প্রদান হবে, যা স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করবে।
৩. সমৃদ্ধ ডিজিটাল লাইব্রেরি:
আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সামগ্রী ও জার্নালের সাবস্ক্রিপশনসহ ডিজিটাল লাইব্রেরি স্থাপন করতে হবে। JSTOR, Scopus, ScienceDirect-এর মতো ডাটাবেজে অ্যাক্সেস নিশ্চিত করতে হবে এবং লাইব্রেরিয়ানদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে গবেষণা সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন।
৪. IQAC-এর কার্যকরী ভূমিকা:
IQAC-এর কার্যক্রম Outcome-Based Education (OBE)-এর বাইরে গিয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ পরিকল্পনা, ক্লাস পর্যবেক্ষণ এবং মনিটরিং ও ইভালুয়েশনের মধ্যে বিস্তৃত করতে হবে। শিক্ষকের দক্ষতা মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। IQAC-এর অধীনে একটি স্বতন্ত্র মনিটরিং ও ইভল্যুয়েশন টিম গঠন করতে হবে যারা প্রশিক্ষণের কার্যকারিতা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের মতামত বিশ্লেষণ করে শিক্ষকের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার (মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া) অভিজ্ঞ অধ্যাপক ও প্রশিক্ষকদের নিয়ে এসে শেখার আদান-প্রদানের কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে।
৫. গবেষণার কাঠামোগত সহযোগিতা ও মূল্যায়ন:
সক্রিয় রিসার্চ সেল প্রকল্প আহ্বান, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন ও গবেষণার ফলাফল প্রকাশের জন্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা প্রস্তাবনা লেখার প্রশিক্ষণ, সফটওয়্যার প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপনার সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রকল্প আহ্বানের আগে শিক্ষকদের জন্য ‘গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাবনা কীভাবে লিখতে হয়’ সে বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পরে প্রস্তাবনাগুলোর গুণগত মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদন এবং ফান্ড বরাদ্দ দিতে হবে। প্রকল্প শেষে ‘গবেষণা প্রতিবেদন কীভাবে লিখতে হয়’ সে বিষয়ে আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশনা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথ গবেষণা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময় এবং একাডেমিক ভিজিট চালু করতে হবে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে।
৭. বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ:
প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষককে বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরকে একটি পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যেখানে প্রতি বছর ২০ জন সিনিয়র শিক্ষককে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হবে।
৮. শিক্ষকদের জবাবদিহি ও শিক্ষার্থীদের মতামত:
প্রতিটি কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের অজ্ঞাতনামা মতামত সংগ্রহ করতে হবে, যা শিক্ষকদের উন্নয়নে সহায়ক হবে এবং বিভাগীয় প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
৯. প্রশাসনিক সময়নিষ্ঠতা ও শৃঙ্খলা:
একাডেমিক ক্যালেন্ডার, পরীক্ষার রুটিন ও ফল প্রকাশ সময়মতো করতে হবে। এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
১০. ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ:
গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাত, এনজিও ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে হবে। এতে গবেষণার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়বে।
১১. ঢাকাকেন্দ্রিকতা ভাঙতে হবে:
নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে ঢাকার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঠিক সমন্বয় ও বরাদ্দ প্রয়োজন।
১২. বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার সেন্টার স্থাপন:
শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের প্রস্তুতির জন্য ক্যারিয়ার সেন্টার অপরিহার্য। এই সেন্টার বিভিন্ন কোম্পানি, এনজিও, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে ইন্টার্নশিপ, চাকরি বিজ্ঞপ্তি, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। সিভি প্রস্তুতি, মক ইন্টারভিউ, সফট স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের যোগ্য করে তুলবে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিং এবং প্লেসমেন্ট রেট বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।
৫ আগস্টের আন্দোলনের যে গণজাগরণ তৈরি হয়েছে, তা যেন কেবল একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না হয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি স্থায়ী গুণগত পরিবর্তনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে—এই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রত্যয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে না দেখে গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এখনই সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার। উচ্চশিক্ষা যেন প্রতিযোগিতামূলক নয়, বরং গুণগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়—সেই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
স্নাতকোত্তর গবেষক, এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (AIT), থাইল্যান্ড
মন্তব্য করুন