গত রোববার রাতে গাজা শহরে আল শিফা হাসপাতালের পাশে সাংবাদিকদের জন্য নির্মিত তাঁবুতে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এ হামলায় তাঁবুতে অবস্থানরত সাতজন মৃত্যুবরণ করেন, যাদের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন আলজাজিরার সাংবাদিক। আনাস আল-শরিফের সঙ্গে প্রাণ হারান তার সহকর্মী প্রতিবেদক মোহাম্মেদ ক্রেইকেহ এবং ক্যামেরা অপারেটর ইব্রাহিম জহির, মোহাম্মেদ নওফাল ও মোয়ামেন আলিওয়া। আনাসের সাহসী প্রতিবেদনের জন্য ইসরায়েলি বাহিনী আগেও তাকে প্রাণহানির হুমকি দিয়েছিল। মৃত্যু অতিসন্নিকটে বুঝতে পেরে তিনি একটি বার্তা প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর পর সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তার বার্তাটি ছিল নিম্নরূপ:
আমার এই বাক্যগুলো যদি তোমাদের কাছে পৌঁছায়, তবে জেনে রেখো যে, ইসরায়েল আমার জীবন কেড়ে নিয়েছে। আমার কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে তারা। প্রথমেই দোয়া করি যে তোমাদের প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। আল্লাহ সাক্ষী আছেন, আমি আমার সর্বশক্তি এবং সামর্থ্য দিয়ে অসহায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি, তাদের কণ্ঠস্বর হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে চোখ খুলে জীবন শুরু হয়েছে আমার, শৈশব থেকেই সেই শরণার্থীশিবিরের সরু গলিপথে আর রাস্তায় বড় হয়েছি আমি। আমার আশা ছিল যে, আল্লাহ আমাকে আরও কিছুদিন জীবিত রাখবেন, যেন আমি আমার পরিবার ও আপনজনদের নিয়ে আমাদের পুরোনো ঠিকানা, দখলকৃত শহর আল-মাজদাল আসকালানে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু সেই সুযোগটা আমার হলো না, তার আগেই আল্লাহর ডাক চলে আসছে। তার বিধানই চূড়ান্ত।
আমি আমার জীবনের প্রতিটি ধাপেই বর্ণনাতীত যন্ত্রণা সহ্য করেছি, অসংখ্যবার আপনজনদের হারানোর বেদনা আস্বাদন করেছি। তবুও কখনো সত্যকে বিকৃত করিনি, নজর আন্দাজ করিনি কোনো অন্যায় ঘটনাকে। যেটা সত্য, সেটাকে বিনা দ্বিধায় প্রকাশ করে গেছি। আল্লাহ যেন সাক্ষ্য রাখেন তাদের বিরুদ্ধে, যারা আমাদের শ্বাসরোধ করেছে। আর তাদের বিরুদ্ধেও, যারা নীরব থেকেছে, যারা আমাদের হত্যাকে মেনে নিয়েছে, আমাদের নারী ও শিশুদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ দেখেও যাদের হৃদয় গলে যায়নি এবং যারা এই দীর্ঘ দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গণহত্যা থামাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
আমি তোমাদের হাতে অর্পণ করে যাচ্ছি বিশ্ববাসীর স্বাধীন হৃদয়ের স্পন্দন এবং গোটা মুসলিম বিশ্বের রত্ন ফিলিস্তিনকে। তোমাদের হাতে অর্পণ করছি এর মানুষদের, এর নিরপরাধ ও অবলা শিশুদের, যারা কোনো স্বপ্ন দেখার বা নিরাপদে বাঁচার অবকাশ পায়নি। ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র ও হাজার হাজার টনের বোমার নিচে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে যাদের কঙ্কাল, ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রাচীরের গায়ে ছিটকে পড়েছে যাদের নিষ্পাপ দেহের মাংসপিণ্ড, তাদের মৃত্যুকে তোমরা বৃথা যেতে দিও না। আমি তোমাদের প্রতি আহ্বান জানাই, ক্ষমতাসীনরা যেন তোমাদের কণ্ঠরোধ করতে না পারে, রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা যেন তোমাদের মানবতার বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত না রাখতে পারে। তোমরা একতাবদ্ধ থেকো, এই ভূমি আর তার মানুষের মুক্তির উদ্দেশ্যে। যতক্ষণ পর্যন্ত না মর্যাদা এবং স্বাধীনতার সূর্য আমাদের অন্যায়ভাবে দখল হয়ে যাওয়া মাতৃভূমির আকাশে উদিত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আমাদের সঙ্গে থেকো।
আমি তোমাদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে যাচ্ছি আমার পরিবারের, আমার স্নেহধন্য কন্যা, আমার চোখের আলো শামের। আমার কাজের দায়বদ্ধতার জন্য আমি তাকে মন ভরে বড় হতে দেখতে পারিনি। অর্পণ করে যাচ্ছি আমার প্রিয় পুত্র সালাহর দায়িত্ব, যাকে আমি ততদিন পর্যন্ত সমর্থন ও সঙ্গ দিতে চেয়েছিলাম, যতদিন পর্যন্ত না সে সুপুরুষ হয়ে আমার স্থান গ্রহণ করতে পারে এবং ফিলিস্তিনের মুক্তির দাবি নিরঙ্কুশভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি তোমাদের হাতে অর্পণ করছি আমার স্নেহময়ী মায়ের দায়িত্ব, যার দোয়া আমাকে এই জায়গা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তার প্রার্থনা ছিল আমার দুর্গ, যার আলোকচ্ছটা আমাকে শেষ অবধি পথ দেখিয়েছে। আমি দোয়া করি যেন আল্লাহ তাকে শক্তি দিন এবং তার প্রতি সর্বোত্তম প্রতিদান দিন আমার পক্ষ থেকে।
আমি তোমাদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে যাচ্ছি আমার জীবনসঙ্গী, আমার দুঃসময়ের সাথি, প্রিয়তমা স্ত্রী উম্মে সালাহ বায়ানের, যার কাছ থেকে যুদ্ধ আমাকে বহুদিন দূরে সরিয়ে রেখেছে। শত প্রতিবন্ধকতার পরও সে আমাদের পারিবারিক বন্ধন অক্ষুণ্ন রেখেছে। একজন ধৈর্যশীল নারী, আল্লাহর ওপর যে সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছে আর আমার অনুপস্থিতিতে নিজ সামর্থ্য দিয়ে ইমানের সঙ্গে সব দায়িত্ব পালন করেছে। আমি তোমাদের কাছে অনুরোধ করছি, তোমরা আমার পরিবারের পাশে থেকো। আল্লাহতায়ালার পর তোমরাই তাদের একমাত্র সহায়।
যদি আমি মৃত্যুবরণ করি, তবে জেনো যে, আমি আমার নীতির ওপর অটল থেকেই মৃত্যুবরণ করেছি। আল্লাহর সামনে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি তার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট, মৃত্যুর পর তার সাক্ষাৎ লাভের জন্য আমি উদ্দীপ্ত হয়ে আছি। আমি নিশ্চিত যে, পরকালের জন্য আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তা উত্তম ও চিরস্থায়ী। হে আল্লাহ, আমাকে শহীদদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দিন আর আমার মৃত্যুকে এমন এক প্রেরণায় পরিণত করুন, যা আমার জাতি ও পরিবারের স্বাধীনতা অর্জন করতে সহায়তা করবে।
আমার পরিজন, আমার পাঠক, আমার দর্শকদের প্রতি আমার দাবি হলো, যদি আমি কোথাও ত্রুটি করে থাকি, তবে আমাকে ক্ষমা করবেন এবং আমার জন্য রহমতের দোয়া করবেন। কারণ আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি, কখনো তা পরিবর্তন করিনি বা আপনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আর বিশ্ববাসীর কাছে আমার শেষ আবদার হলো, তোমরা গাজাকে ভুলে যেও না, ফিলিস্তিনকে ভুলে যেও না।
লেখক: সদ্যপ্রয়াত আলজাজিরার প্রতিবেদক। বার্তাটি যুক্তরাজ্যের পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন