স্বাধীনতার শতাব্দী পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে ‘বিকশিত ভারত @২০৪৭’ শিরোনামে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে ভারত দ্রুতগতির মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নের যাত্রা শুরু করেছে। বিগত দশকটি জাতীয় ও কৌশলগত পরিসরে ছিল ব্যতিক্রমী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক দাসত্বপূর্ণ মানসিকতা ত্যাগ করে সংস্কারকরণ, সম্পাদন ও রূপান্তরকরণের মন্ত্র নিয়ে উত্থান ঘটানো ও উদ্ভাসিত হওয়ার আহ্বান এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে লাভজনক ফল পেতে শুরু করেছে। ১ হাজার ৫৫০টিরও বেশি পুরোনো ও জটিল আইন বাতিল করা হয়েছে এবং আইনশাস্ত্র আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে ১৩০তম স্থান থেকে ভারত দ্রুত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে ৬৩তম স্থানে পৌঁছেছে, যার ফলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্ভাবনী বাস্তুসংস্থান দশ বছর আগের মাত্র ৫০০টি স্টার্টআপ থেকে ১১৮টি ইউনিকর্নসহ ১.৬ মিলিয়ন স্টার্টআপ তৈরি করেছে। ‘ফ্রাজাইল ফাইভ’ থেকে মাত্র এক দশকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠা যে কোনো মানদণ্ডে এক অসাধারণ অর্জন। আইএমএফের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্লুমবার্গের মতে, ২০২৫-৩০ সাল পর্যন্ত চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র তিনটি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান সমর্থক এবং ‘গ্রিন অ্যাপারথেড’-এর বিরুদ্ধে মুখপাত্র হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে ‘জিরো কার্বন’-এর লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু সব দিক বিবেচনায়, লক্ষ্যটি অনেক আগেই অর্জন করা সম্ভব হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০১৫ সালে, ভারত ফ্রান্সের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স (আইএসএ) চালু করে, যা সম্ভবত ১৯৫০-এর দশকের ন্যাম আন্দোলনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। একটি বিশাল অর্জন হলো, ভারতে স্থাপিত বিদ্যুৎ ক্ষমতার ৫০ শতাংশ এখন অ-জীবাশ্ম উৎস থেকে আসে। এটি ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। ভারত উচ্চাশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কার্যে রূপান্তরিত করছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জি২০-এর সভাপতিত্বকালে ভারত শুধু আরেকটি বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ ‘দ্য গ্লোবাল বায়োফুয়েলস অ্যালায়েন্স’ চালুই করেনি, বরং এর আগেই ইথানল মিশ্রণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। একই কথা তার ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশনসের (এনডিসি) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যেখানে ভারত হলো প্রথম ও দ্রুততম বাস্তবায়নকারী।
অতিমারি বিশ্বকে নজিরবিহীনভাবে আঘাত করেছিল। কিন্তু ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল অনন্য, কারণ এটি পরিচালিত হয়েছিল তার ডিএনএতে নিহিত ‘বাসুধৈব কুটুম্বকম’—‘পৃথিবী এক পরিবার’—নীতিবাক্য দ্বারা। যখন শক্তিশালী দেশগুলো ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ভ্যাকসিন ও ওষুধ মজুত করছিল, তখন ভারত শুধু নিজের জন্য নয়, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার জন্যও উৎপাদন করে এবং ‘ভ্যাকসিন মৈত্রী’ কর্মসূচির মাধ্যমে শতাধিক দেশে কয়েক বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, ভারতকে বিশ্বের এক-ষষ্ঠাংশ মানুষের জন্যও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছিল, যারা ভারতে বসবাস করে। স্বাস্থ্যসেবা যখন মৌলিক অগ্রাধিকার হয়ে ওঠে, তখন ভারত সরকার-অর্থায়িত বীমা কর্মসূচি ‘আয়ুষ্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা’ (এবি-পিএমজেএওয়াই) চালু করে, যা ২০১৪ সালের পর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা যায়। এটি একটি বিশাল আকারের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি। এবি-পিএমজেএওয়াইর আওতায় ৩৪.৫ কোটি আয়ুষ্মান কার্ড প্রদান করা হয়েছে এবং ২৯ হাজার ৯১৪টি হাসপাতালকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় হাসপাতালে ৬.৫ কোটির বেশি অনুমোদিত চিকিৎসা সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তীকালে ৭০ বছরের বেশি বয়সী প্রবীণ নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটিকে আরও সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
ভারত মূলত একটি কৃষিভিত্তিক দেশ এবং কৃষকরাই ভারতের ও তার খাদ্য নিরাপত্তার মেরুদণ্ড। তাই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা রাউন্ডেও ভারত সর্বদা বিপুলসংখ্যক উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থ ও অধিকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন উদ্যোগ ও তৃণমূল পর্যায়ে সংস্কারের মাধ্যমে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক কৃষকের জন্য সয়েল হেলথ কার্ড প্রকল্প, ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট (ই-ন্যাম), প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা (পিএমকেএসওয়াই) এবং প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা (পিএমএফবিওয়াই), যা কৃষকদের জন্য খুবই কম প্রিমিয়ামে বীমা সেবা প্রদান করে থাকে। ২০১৫ সালে চালু হওয়া পিএমকেএসওয়াই প্রকল্প ক্ষুদ্র সেচ প্রযুক্তির ব্যবহারকে সমর্থন করে, যা একটি ফসল বীমা প্রকল্প। গত এক দশকে খাদ্যশস্য উৎপাদন ২৫২ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩২ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে, যাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা ভারত সরকারের অন্যতম বৃহত্তম কাজগুলোর একটি। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসেবে, ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় পরিচালিত টার্গেটেড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (টিপিডিএস) ৮১.৩৫ কোটি (৮০০ মিলিয়নের বেশি) সুবিধাভোগীকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা গ্রামীণ ও শহুরে জনগোষ্ঠীকে খাদ্যশস্য সরবরাহ করে থাকে। সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো, যেমন প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার আওতায় বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ আরও পাঁচ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা, সরকারের প্রতিশ্রুতির একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।
আত্মনির্ভরতা (আত্মনির্ভর ভারত) এখন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ ও ‘লোকাল ফর গ্লোবাল’-এর মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে, যাতে ভারত বিশ্বমানের মূল্য শৃঙ্খল ও সরবরাহ শৃঙ্খলের অংশ হতে পারে এবং বিশ্বের স্মার্ট উৎপাদন ও সেবা কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সন্ত্রাসের প্রতি শূন্য সহনশীলতার নীতিতে, পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী আস্তানার বিরুদ্ধে ‘অপ-সিন্দুর’ অভিযানে দেশীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শত্রুর ওপর ভয়াবহ আঘাত হেনেছিল।
ভারত শুধু মহাকাশ অনুসন্ধান যেমন, প্রথমবারের মতো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ এবং চন্দ্রযান থেকে গগনযান মিশনেই নয়, বরং ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই) ও ইউনিক ডিজিটাল আইডেন্টিটি আধার ও সমগ্র ভারতে বিপুলসংখ্যক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরাসরি অ্যাকাউন্টে সুবিধা ও অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রেও উৎকর্ষ অর্জন করেছে। আধারকে জনধন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল নাম্বারের (‘জ্যাম’ ত্রয়ী) সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিতরণ প্রক্রিয়াকে সুসংহত করেছে, জালিয়াতি হ্রাস করেছে এবং নিশ্চিত করেছে যে, সুবিধাগুলো সরাসরি ও কার্যকরভাবে নির্ধারিত প্রাপকদের কাছে পৌঁছায়। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অতিমারির সময়, যখন সবচেয়ে যাদের বেশি প্রয়োজন, সেই সব ব্যক্তির কাছে দ্রুত ও লক্ষ্যভিত্তিকভাবে আর্থিক সহায়তা বিতরণ করা সম্ভব হয়েছিল। এসব ডিজিটাল টুলস, অ্যাপসমূহ ও ডিজিটাল পাবলিক গুডস বিশ্বের জন্য বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উপলব্ধ করা হয়েছে। ‘সবার জন্য এআই’, ‘এক পৃথিবী এক স্বাস্থ্য’, ‘এক গ্রিড এক বিশ্ব’ শুধু স্লোগান নয়, বরং ভারতের সভ্যতাগত চেতনায় নিহিত এক পুনর্জাগ্রত ভারতের নীতিগত নির্দেশনা।
এ ভঙ্গুর বিশ্ববিন্যাসে, ভারতের সমঝদার ও মূল্যভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী, সহনশীল ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে, যা কৌশলগত স্বনির্ভরতা ও বহুমুখী সমন্বয়ের মাধ্যমে নিজের শক্তি পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে এবং সংস্কারকৃত বহুপক্ষীয়তা ও বহুকেন্দ্রিকতা প্রতিষ্ঠা করছে। সম্পর্কে শীতলতা থাকার পরও, সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি যখন জি৭ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আবার আমন্ত্রণ জানান, তখন এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে, ভারতকে আলোচনার টেবিলে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ক্রমেই জি৭ থেকে জি২০, ব্রিকস ও এর বাইরেও নীতিনির্ধারক হয়ে উঠছে। বৈশ্বিক দক্ষিণের স্বার্থ উদাহরণ ও প্রচারের মাধ্যমে এবং তাদের বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠস্বর হয়ে, পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবকেন্দ্রিক পন্থা অনুসরণ করে সেবা প্রদান করছে।
লেখক: প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এবং বিবেকানন্দ আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের বিশিষ্ট ফেলো
মন্তব্য করুন