প্রতি বছর দেশের সড়কগুলোয় বিপুলসংখ্যক প্রাণ ঝরে পড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ দায়ী। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বারবার সামনে আসে চালকের একটানা বিরামহীন, বিরতিহীন গাড়ি চালানোর ঘটনা। চালকের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টায় সীমিত থাকার আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত এ মৃত্যুর পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। এটি অত্যন্ত হতাশার।
সোমবার কালবেলায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বিশ্রামবিহীন চালকের নিয়ন্ত্রণহীনতায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় চালক ও পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যুও বাড়ছে। তিন বছরের ব্যবধানে সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবহন চালক ও শ্রমিকের মৃত্যু প্রায় এক হাজার বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত চালকের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণেই বেশি ঘটছে দুর্ঘটনা। সেইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের সব সদস্য কিংবা অধিকাংশ সদস্যেরই নিহত হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এক পরিবারের সবার মৃত্যু হয়েছে—এমন ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৮৫টি। এসব দুর্ঘটনায় বাবা-মা, সন্তানসহ পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে নিহত হয়েছেন। গত কয়েক মাসে এমন বেশ কিছু দুর্ঘটনার খবর এসেছে, যেখানে একটি গাড়িতে থাকা মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই মারা গেছেন ঘটনাস্থলেই। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ১২টি ঘটনায় একসঙ্গে পুরো পরিবার নিহত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালকের ঘুমিয়ে পড়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তার মানে একটানা বিরতিহীন গাড়ি চালানোয় যে অতিরিক্ত চাপ চালকের ওপর পড়ছে, দুর্ঘটনার জন্য সেটাই অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। এ ছাড়া সড়কে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালক এবং তদারকির অভাবও এসব মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী।
গাড়িচালকসহ পরিবহন চলাকালে অন্যান্য স্টাফের ক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান আইন পরিবহন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা নির্ধারণের কথা স্পষ্টভাবে বলছে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ আইনের ৩৯(১) ধারায় উল্লেখ আছে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সালের ৪২ নং আইন) এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন যানের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার-কাম-ক্লিনারদের কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল নির্ধারণ করতে পারবে। সেইসঙ্গে ৩৯(২) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অথবা পরিবহন যানের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার-কাম-ক্লিনার উপধারা (১)-এর অধীন নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল মেনে চলবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ আইন মানছে না কোনো পক্ষই।
খুবই প্রাসঙ্গিক কথা হচ্ছে, কেউ যদি আইন না মানে, তার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও বিধান রয়েছে প্রচলিত আইনেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা কি এ বিধান প্রয়োগ করছে? বিনাসংশয়ে বলা যায়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের কোনো তৎপরতা নেই। স্বভাবতই সড়কে অনিয়ম পরিণত হয়েছে নিয়মে! ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের মিছিলও দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা মনে করি, আইন শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। দরকার বাস্তবায়নের। তবেই তা জনকল্যাণে আসবে। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক এবং কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। শুধু চালকের কর্মঘণ্টার সময়সীমা নয়, সড়কে বিরাজমান যেসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ন্ত্রণ বা প্রশমনে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হবেন—এটাই প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন