জুলাই জাতীয় সনদ ও গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দরকষাকষি ও জটিলতার অবসান ঘটিয়ে দেশ কি এবার নির্বাচনের দিকেই যাচ্ছে? এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচনবিহীন দেশ কি প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত ইতিহাসের ‘সেরা নির্বাচনের’ জন্য প্রস্তুত হচ্ছে? যে নির্বাচন আর মাত্র চার মাস দূরে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে সময় নেই আর সময় নষ্ট করার। নির্বাচন নিয়ে জনমনে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সংশয়ের মধ্যে গত সপ্তাহে রাজনীতিতে কিছু ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। অবশেষে জুলাই সনদ স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে ১৭ অক্টোবর। প্রথমে ১৫ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষরের ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে তা দুদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে ঐকমত্য কমিশন থেকে বলা হয়েছে, শুক্রবার ছুটির দিনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান দুদিন পেছানো হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে ১৭ অক্টোবর বেলা ৩টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবেন সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের প্রতিনিধিরা। প্রায় আট মাস ধরে চলা রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের সমাপ্তি ঘটেছে গত বুধবার। তবে গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ না মিটিয়েই ঐকমত্য কমিশন সংলাপ শেষ করেছে। গণভোটের বিষয়টি সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কমিশন।
গত সপ্তাহে রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিবিসি বাংলাকে দেওয়া দুই পর্বের সাক্ষাৎকার। প্রায় দুই দশক পর তিনি এই প্রথম গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি শিগগিরই দেশে ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথাও। সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমি একজন রাজনৈতিক দলের সদস্য। নির্বাচনের সঙ্গে তো রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মীর ওতপ্রোত সম্পর্ক। কাজেই, সেখানে তো অবশ্যই আমি নিজে দূরে থাকতে পারব না। আমাকে আসতেই হবে। স্বাভাবিকভাবেই মাঠে থাকব, অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নেব।’ তারেক রহমান সাক্ষাৎকারে নির্বাচনে দলের কৌশল, চেয়ারপারসনের অংশগ্রহণ, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও মাস্টারমাইন্ড প্রসঙ্গ, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও অপরাধীদের বিচার, দুর্নীতি চাঁদাবাজি, দখল নিয়ে কথা বলেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কথা বলেছেন জামায়াতের রাজনীতি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়েও। তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারটি রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দেয় এবং প্রশংসিত হয়। তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাননি, সব প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন। কোনো প্রশ্নেই প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে কৌশলের সঙ্গে জবাব দিয়েছেন। বলা যেতে পারে, বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতির একটি পথরেখা এ সাক্ষাৎকারে অনেকখানি স্পষ্ট হয়েছে।
গত সপ্তাহের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাত বছর পর প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করা। বুধবার রাত ১১টায় তিনি স্বামীর সমাধিস্থলে যান। বিবিসি বাংলায় তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার প্রচারের এক দিন পর খালেদা জিয়া স্বামীর কবর জিয়ারত করেন। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা নিয়ে বিবিসি বাংলা প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেছেন, ‘জনপ্রত্যাশী যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার (খালেদা জিয়া) শারীরিক সক্ষমতা যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।’ খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্পর্কিত এ প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমানের জবাব ছিল, ‘এটি এখনো বলতে পারছি না। তার শারীরিক সক্ষমতার ওপর বিষয়টি কিছুটা নির্ভর করছে।’ তবে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এর আগে খবর বেরিয়েছে।
গণভোটের সময় ও পদ্ধতির বিষয়টি এখন পর্যন্ত ঝুলে থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে দূরে তো নয়ই, বরং কোনো কোনো দল বেশ জোরেশোরে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছে। ৩০০ আসনের প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে সব দলের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামী। বেশ আগেভাগেই প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করে প্রার্থীদের পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারে নামিয়ে দিয়েছে দলটি। জামায়াত একই সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে জোট করে ভোট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এনসিপিকেও কাছে টানতে চাইছে জামায়াত। নির্বাচনের মাঠে গণঅভ্যুত্থানের আবেগ ও কৃতিত্ব বিবেচনায় নিয়ে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল এনসিপিকে জোটে নিতে তৎপর জামায়াত। মাত্র আট মাস আগে গঠিত এনসিপি ‘মৌলবাদী’ বা ‘ডানপন্থি’ ট্যাগের ভয়ে জামায়াতের সঙ্গে জোট করতে আগ্রহী নয়। বর্তমানে বৃহৎ দল বিএনপিও নির্বাচনে এনসিপিকে সঙ্গে রাখতে চায়। দল দুটির মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি। পর্দার অন্তরালে নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা চলছে বলে তারেক রহমান সোমবার ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিএনপি অন্য দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠনে প্রস্তুত। এসব দলের মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সামনের কাতারে থাকা ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি নতুন দলও রয়েছে।
বিএনপি এখন পর্যন্ত প্রার্থী ঘোষণা না করলেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেককেই সবুজ সংকেত দিয়েছে। তবে সংকেত পাওয়া বা না পাওয়া সম্ভাব্য প্রার্থীরা যার যার আসনে নির্বাচনী গণসংযোগ শুরু করেছেন অনেক আগে থেকেই। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে জামায়াত বিএনপির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পিআর পদ্ধতি, গণভোট ইত্যাদি প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী এক ধরনের প্রাধান্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিল প্রথম থেকেই। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফল দলটিতে আরও উজ্জীবিত করেছে। নির্বাচনে লড়তে প্রথম দফায় ১৪০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করল এই জোটটি। গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির ভোটের সমঝোতার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলটি নিজের জন্য কত আসন রেখে সর্বোচ্চ কত আসন ছাড়তে পারবে, তার ওপর সমঝোতার বিষয় নির্ভর করছে।
প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ১৪ মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেছে। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রফেসর ইউনূস সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রায় এক ডজন কমিশন গঠন করেন। এত এত কমিশন করার আদৌ দরকার ছিল কি না, তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এমন অনেক সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, যেগুলোর সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাস্তবায়নের সুযোগ বা সময়, কোনোটাই নেই। এ প্রসঙ্গে নারী সংস্কার, স্বাস্থ্য সংস্কার, মিডিয়া সংস্কারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রফেসর ইউনূস সরকারের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও এসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো অগ্রগতির খবর জানা নেই। প্রধান উপদেষ্টা হয়তো বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের ভালো আকাঙ্ক্ষা থেকেই এতসব কমিশন গঠন করেছিলেন। তবে তিনি এ ক্ষেত্রে সময় বিবেচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
একই কথা দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে নিয়োজিত গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এসব দল ও জোট এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মূলত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। অথচ এখন সংসদের উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষ, পিআর, গণভোট, গণপরিষদসহ অসংখ্য বিষয় সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এ যেন প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মতো অবস্থা। গণভোটের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত হয়ে আছে। নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট নাকি আগে হবে, তা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে মূলত জামায়াতের রশি টানাটানি চলছে। তবে গণভোট আয়োজনের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আগে বা ভোটের দিন—যখনই গণভোট করা হবে তার জন্য আলাদাভাবে ব্যাপক প্রস্তুতির দরকার আছে। তা ছাড়া দেশে যে কয়টি গণভোট হয়েছে, এর প্রতিটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গণভোট নিয়ে যা চলছে তাতে মনে হয়, ১৭ বছর পর জাতীয় নির্বাচন নয়, গণভোটেই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
সংসদের উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ নিয়েও বিতর্ক চলমান। এ বিতর্ক শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জনপরিসরেও এ বিতর্ক জারি আছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও যেখানে এক কক্ষের সংসদ কার্যকর করা এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়নি, সেখানে উচ্চকক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কী রক্ষাকবজ হবে, তা যে দলগুলো এই উচ্চকক্ষ নিয়ে উচ্চকিত, তারাই ভালো বলতে পারবে। গত বৃহস্পতিবার এক সংলাপে গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, দেশের বর্তমান বাস্তবতায় সংসদে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই। সংলাপে জানানো হয়, ঐকমত্য কমিশনকে সিপিডির গবেষকরা বলেছেন, তারা যেন চূড়ান্ত ঐকমত্যের তালিকা থেকে উচ্চকক্ষ সংসদ গঠনবিষয়ক প্রস্তাবটি বাদ দেন। সিপিডির ওই সংলাপে উঠে এসেছে যে, রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র চর্চা না হলে বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করা না গেলে, পদ্ধতির পরিবর্তন করে কোনো লাভ হবে না।
নির্বাচনবিহীন দেশে প্রায় সবক্ষেত্রে কার্যকর সরকারের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। জনপ্রশাসন গতিশীল নয়, পুলিশ বিভাগ এখনো তাদের সক্ষমতা পুরোপুরি প্রমাণ করতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন মহল থেকে নানামুখী তৎপরতা রয়েছে। গুমের ঘটনায় করা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চাকরিতে থাকা ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর সেনানিবাস ঘিরে নানা জল্পনা-গুঞ্জন তৈরি হয়। বিশেষ করে রাতের বেলায় এসব গুঞ্জন প্রবল হয়ে ওঠে। তবে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর চাকরিতে থাকা ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে সেনাবাহিনী।
দেশের মানুষ ১৭ বছর পর একটি প্রত্যাশিত নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য সময় গুনছে। পাশাপাশি দাতা দেশসহ গণতান্ত্রিক সব দেশ একটি নির্বাচিত সরকার দেখার অপেক্ষায় আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত সরকারপ্রধান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ছোটাছুটি করছেন। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থার অভাব রয়েছে। কর্মসংস্থানে নেমেছে ধস। জনমনে নিরাপত্তা, নির্বাচন সবকিছু নিয়ে এখনো শঙ্কা বিরাজ করছে। শুধু একটি নির্বাচন সব সমস্যার সমাধান এনে দেবে তা যেমন ঠিক নয়, তেমনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এ শঙ্কা দূর করার সূচনা করতে পারে। ছাব্বিশের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের উপস্থিতি অনেক সমস্যা ও সংকটের জট খুলতে পারবে, এমনটাই প্রত্যাশা করা যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন