মোতাহার হোসেন
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রযুক্তি, প্রজন্ম ও মূল্যবোধের টানাপোড়েন

প্রযুক্তি, প্রজন্ম ও মূল্যবোধের টানাপোড়েন

পরিবর্তিত বিশ্ব জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিনির্ভর। বর্তমান প্রজন্মই হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর। বিশেষ করে ৫ বছর বয়স থেকে ৩০ বছরের ভরা যৌবনের যুবকরাই হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর পরিবর্তিত বিশ্বের নিয়ন্ত্রক। আজ থেকে দেড় দুই যুগ আগেও আমাদের দেশের শিশুরা যেখানে লাটিম, নাটাই, মার্বেল, গুলতি, গোল্লাছুট, হাডুডু খেলে সময় পার করে আনন্দ পেত। এখন সেই বয়সী শিশুরা বিমানে ওড়ার, বিমান বানানোর স্বপ্ন দেখে। তারা কম্পিউটার, মোবাইল অ্যাপস ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অনেকেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্যনতুন উদ্ভাবনে তাদের মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, প্রশাসনিক কাজে ই-ফাইলিং, আদালত পরিচালনায় প্রযুক্তির ব্যবহার, আবহাওয়া, চিকিৎসা, পরিবেশ, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলাসহ দৈনন্দিন প্রযুক্তি বহুমুখী ব্যবহারেও যুক্ত রয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্মের সন্তানরা।

প্রযুক্তিনির্ভর পরিবর্তিত বিশ্বের দেশে দেশে প্রযুক্তির কারণেই মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, মানবিক সম্পর্কে, মূল্যবোধে, রীতিনীতিতে, আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। এর প্রভাব পড়ছে ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের মধ্যে। আরেকটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘আমার বা আমাদের সন্তান মানে আমরা বা আমাদের সন্তান নয়, সেই সন্তান একই সঙ্গে আমার সন্তান ও আমাদের এবং সে একই সঙ্গে প্রকৃতির প্রযুক্তির ছোঁয়ায় লালিত সন্তান।’ কাজেই আমার বা আমাদের ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণের অনুরূপ আমার বা আমাদের সন্তানের মধ্যে প্রতিফলিত হবে এমনটা আশা করা যৌক্তিক বা কাম্য নয়। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে এ পরিবর্তন হয়েছে অবশ্য প্রযুক্তির কল্যাণে। আর এ কারণেই বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্মের সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবক, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজনদের ব্যবধান বা দূরত্ব বাড়ছে ব্যাপকভাবে। এ প্রজন্ম অভিভাবক, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজনদের মনের ভাষা, চোখের ভাষা, মুখের ভাষা বুঝতে পারে না। তাই উভয়ের মধ্যে বোঝাপড়ায় দ্বন্দ্ব, ব্যবধান, দূরত্ব বাড়ছে। তরুণরা প্রতিনিয়ত ওজর আপত্তি করে। প্রবীণরা বা তাদের মা-বাবা, অভিভাবকরা তাদের বোঝে না বা বুঝতে চায় না। আবার পিতামাতা, অভিভাবকদের অভিযোগ, সন্তানরা তাদের বোঝে না বা বুঝতে চায় না। ভুল বোঝাবুঝির এ দ্বন্দ্ব চিরন্তন, চিরকালীন হলেও হাল জামানায় প্রযুক্তির কারণে নতুন প্রজন্মের সন্তানদের সঙ্গে এখন তা আরও চরম আকার ধারণ করেছে। এই কারণে পিতা পুত্রে, পিতা কন্যায় বাড়ে সংঘাত, বাড়ে ঝামেলা আবার কখনো কখনো এই দূরত্ব, ব্যবধান রূপ নেয় সংঘাত, সহিংসতায়, খুনাখুনিতে। এ ধরনের নজির রয়েছে আমাদের সমাজে-সংসারে। অন্যদিকে কখনো বড়রা ছোটদের কাছে দেবতার মতো। তাদের হাতেই ক্ষমতা, স্নেহ, ভবিষ্যতের দিশা খুঁজতে চায়। আবার কখনো তারাই ছোটদের কাছে হয়ে ওঠে ভয়ংকর, অচেনা, অবিশ্বাস্য এক দানবরূপে। এদিকে বড়রা যেন ভুলেই যায়, শিশুরাও সব দেখে, সব বোঝে, যদিও সবসময় বলতে পারে না। এ অদৃশ্য সম্পর্কের দ্বিমুখী টানাপোড়েনে মানবিকতা, সামাজিকতা, লৌকিকতা নির্বাসিত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পসহ বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রয়েছে; যা কি না ছোট-বড়র মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সংঘাতের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এ বিষয়ের সঙ্গে খ্রিষ্টান ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস তার মৃত্যুর আগের দিন ইস্টার সানডেতে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে শান্তির বার্তা দিয়েছেন। তার পক্ষ থেকে এক সহকারী বক্তব্য পাঠ করেন যেখানে তিনি বলেন, ‘অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান ছাড়া কখনোই প্রকৃত শান্তি আসতে পারে না। ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়।’ তাই আমাদেরও মনে রাখতে হবে, ছোট-বড় নির্বিশেষে অন্যের মতের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যের মত আপনার মতের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। তবে তা যুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে—এটাই উত্তম পন্থা।

সম্প্রতি রাজধানীতে এ ধরনের একটি নাটক প্রদর্শিত হয়েছে। ‘গার্ডিয়ান্স অব দ্য গডস’ নাটকের মহড়ার একটি দৃশ্যে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক অভিনেতা অভিনয় করেন শিশু চরিত্রে। তাদের সংলাপে ধরা পড়ে, ‘শিশুর চোখ দিয়ে দেখা বড়দের পৃথিবী কখনো সরল আনন্দ, কখনো তীক্ষ্ণ অভিযোগ, কখনো আবার বিভ্রান্ত নিরূপায়তা। বড়দের আচরণ তারা নিজেদের বয়সী যুক্তিতে ব্যাখ্যা করে; যা একদিকে মজার, আবার অন্যদিকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। দর্শক-আসনে বসা ছোট-বড় সবাই নাটকটিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নিজের মতো করে। শিশুরা হেসেছে, বড়রা ভেবেছে, কেউ কেউ আবার চোখের পানি লুকাতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, নাটকটি মনে করিয়ে দেয়, শিশুরা সবসময় তাদের কষ্ট বা প্রশ্নগুলো প্রকাশ করতে পারে না। অনেক সময় তারা ভাবে, বড়রা হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিংবা শুনলেও গুরুত্ব দেবে না। অথচ সেই না বলা কথাগুলো অনেক সময় এমন অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকে, যা বড়দের জানাতে পারলে অন্যায়টি আর সেই শিশুর সঙ্গে ঘটত না! আবার কখনো কখনো বড়রাই এমন সব আচরণ করে বা কথা বলে, যা তারা ‘স্বাভাবিক’ বলেই ভাবে, কিন্তু তারা জানে না সে আচরণ বা কথাটি ছোটদের ভাবনার জগৎকে রঙিন থেকে সাদা-কালোয় পাল্টে দেয়।

নাট্যকার এরিক উডেনবার্গের লেখা এ নাটক কোনো কাল্পনিক গল্প নয়। সুইডিশ নাট্যদল বিভিন্ন দেশের শিশুদের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতা, ভয়, স্বপ্ন এবং না বলা কষ্টগুলোর গল্প সংগ্রহ করে। সেই বাস্তব গল্পের ভিত্তিতেই ‘গার্ডিয়ান্স অব দ্য গডস’ রচিত। নির্দেশক গুস্তাভ ডেইনফের ভাষায়, ‘এটি শিশুদের হয়ে কথা বলে না, বরং তাদের কণ্ঠকে সামনে আনে।’ বাংলাদেশি সংস্করণে অভিনয় করা তৌফিকুল ইমনের অনুভূতি, ‘এ নাটকে কাজ করা কেবল অভিনয় নয়, বরং একটি বৈশ্বিক আন্দোলনের অংশ হওয়া। নাটকটির বিশেষত্ব এখানেই—এটি শিশুদের জটিল অনুভূতি, তাদের প্রতিরোধ আর ভালোবাসাকে জাদুকরী রূপান্তরের মাধ্যমে মঞ্চে নিয়ে আসে।’ ২০২৫ সালের মে মাসে তুরস্কে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের পর বর্তমানে নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে পাঁচ মহাদেশের ১১ দেশে। প্রতিটি দেশে নিজস্ব ভাষায় অভিনীত হচ্ছে নাটকটি। ফলে একই সঙ্গে সর্বজনীন আর গভীরভাবে স্থানীয় হয়ে উঠেছে এর বার্তা।

‘গার্ডিয়ান্স অব দ্য গডস’ নিছক একটি নাটক নয়, এটি এক সামাজিক হস্তক্ষেপ, এক ধাক্কা; যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিশুদের কণ্ঠ কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর আমরা বড়রা কত সহজে সেই কণ্ঠ উপেক্ষা করি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। শিশুদের চোখ দিয়ে বড়দের পৃথিবী দেখা—এ অভিজ্ঞতা হয়তো দর্শকের মনে দীর্ঘদিন রয়ে যাবে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘সঙ্গী মন্দ, সর্বনাশ অনন্ত’। অর্থাৎ, খারাপ বন্ধুর সঙ্গে চললে জীবনে সর্বনাশ নেমে আসে বা সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। কারণ মানুষের চরিত্র, চিন্তাধারা ও জীবনের গতিপথ চলাফেরা অনেকাংশে তার সঙ্গী দ্বারা নির্ধারিত, পরিচালিত হয়। যেমন, ভালো সঙ্গ আমাদের উন্নতি এবং মঙ্গলের পথে নিয়ে যায়, তেমনি মন্দ সঙ্গ আমাদের অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয়।

এটি সত্য, মানুষ যখন কষ্টে থাকে, যেমন অর্থনৈতিক সংকট, শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক চাপ বা পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত, তখন একজন প্রকৃত বন্ধুর ভূমিকা, পরামর্শ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। সত্যিকারের বন্ধুরা তখন শুধু সান্ত্বনাই দেয় না, বাস্তবে সাহায্যও করে। এসব ছোট ছোট সহায়তাই কঠিন সময়কে সহনীয় করে তোলে। আর যে বন্ধুরা শুধু আনন্দের সময় পাশে থাকে কিন্তু কষ্টের সময় অদৃশ্য হয়ে যায়, তাদের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে গণ্য করা যায় না। আসলে নানা সংকটের সময় বন্ধুত্বের আসল পরীক্ষা হয়। প্রত্যাশা থাকবে প্রযুক্তির এ যুগে নতুন প্রজন্মের সন্তানদের চাওয়া-পাওয়া, তাদের মনোজগতের আকাঙ্ক্ষা, মতিগতি বুঝতে হবে পিতামাতা, অভিভাবক, আত্মীয়দের। একই সঙ্গে তাদের মতামত, চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তাদের সময় দিতে হবে মানবিকতা, সামাজিকতা, নীতিনৈতিকতা সম্পর্কে, শিক্ষা দিতে হবে শিশুকাল থেকে। তাহলে উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, মানসিক দূরত্ব অনেকাংশে কমে আসবে।

লেখক: সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সেলস ম্যানেজার পদে নিয়োগ দিচ্ছে প্রাণ গ্রুপ

এসিআই মোটরসে চাকরির সুযোগ, দ্রুত আবেদন করুন

এক দিনে তাপমাত্রা কমেছে ৩ ডিগ্রি, বইছে ঠান্ডা বাতাস

আজ কোথায় কোন কর্মসূচি

হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল সমুদ্রপাড়ের রিসোর্টে, ভিডিও ভাইরাল

ইতিহাসে আজকের এই দিনের স্মরণীয় ঘটনা

মঙ্গলবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৪ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

আজ থেকে নতুন দামে বিক্রি হবে স্বর্ণ, বাজারদর জেনে নিন

গাজায় হামাসের বন্দুকধারীদের টহল

১০

আগামীর রাষ্ট্রকাঠামোর পূর্ণ রূপরেখা ৩১ দফাতেই রয়েছে : কফিল উদ্দিন 

১১

পরিবেশ রক্ষায় ৮০ হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে : টুকু 

১২

ক্ষমতায় এলে ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান গড়বে বিএনপি : আমিনুল হক

১৩

মিসরে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেলেন ট্রাম্প

১৪

নেইমারের জন্য এখনও দরজা খোলা রেখেছেন আনচেলত্তি

১৫

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ ও প্রফেশনাল কোর্সের সব পরীক্ষা স্থগিত

১৬

ইতিহাস গড়ে ফুটবল বিশ্বকাপের টিকিট পেল কেপ ভার্দে

১৭

পলিথিনে মোড়ানো শপিং ব্যাগে মিলল নবজাতকের মরদেহ

১৮

রোমে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক

১৯

কলাবাগানে ডিপ ফ্রিজ থেকে নারীর মরদেহ উদ্ধার

২০
X