সবাইকে একমতে আনা মানে ঐকমত্যের ইকামতি-ইমামতি কোনোটা থেকেই রক্ষা নেই সরকারের। যে যেভাবেই চটাক, উসকাক, সেফ এক্সিট চাচ্ছে বলে বদনাম করুক, আখের গোছানোর অভিযোগ আনুক; রাগ-অনুরাগ-বিরাগে কাজ ফেলে চলে যাওয়ার সুযোগ নেই। শেষ করতে না পারলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে হবে। সংস্কারও আনতে হবে। ওয়াদামতো চমৎকার নির্বাচনের ব্যবস্থা তো করতে হবেই। গন্ডারের চামড়া লাগিয়ে হলেও সব হজম করা ছাড়া উপায় নেই। দৃশ্যত সরকার সেই মন-মর্জির অভিযাত্রায় এগোচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আবার বাড়িয়েছে। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কাজ করবে এ কমিশন। যার সভাপতি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেখভালে আছেন সহসভাপতি প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ। নানান বদনাম, সমালোচনা, কটুকথায় খেই হারান না তিনিও।
৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কমিশন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবে। আজকের সনদ সই আয়োজনকেও সহনীয় করে দেওয়া হয়েছে। এক দিন আগে বৃহস্পতিবারই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনো দল চাইলে পরে একসময় সই করলেও হবে। জুলাই জাতীয় সনদকে কীভাবে আইনি ভিত্তি দেওয়া যায়, এই সনদ যাতে বাস্তবায়ন হয়, সেভাবে কাজ করছে কমিশন। শুধু এনসিপি-সিপিবি নয়, সবার প্রস্তাবই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। বিএনপির নোট অব ডিসেন্টগুলোরও একটা বন্দোবস্ত থাকবে। চাপে-চ্যাপ্টা তাপে তপ্ত দশায়ও সরকারের এ কোমল-কুসুম অভিযাত্রা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের অংশ হয়ে না থেকে পারে না। নমনীয়তার আরও অনেক দৃষ্টান্ত শুরু থেকেই রেখে আসছে সরকার। চটছে না, আক্রমণাত্মক হচ্ছে না কারও ওপর। আবার কারও তেলে তেলতেলে হচ্ছে না। আবার ঝেড়েও ফেলছে না।
সয়াবিনসহ ভোজ্যতেলের দাম যে এক লাফে এত উঠে গেল, তাও দমাচ্ছে না। এ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীরা যা ঘটানোর ঘটিয়ে দিয়েছে। এর ব্যানারে ভেজিটেবল ওয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে দেখা দেওয়া ধোঁয়াশার অবসানের লক্ষণ নেই। ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে কয়েক মাস ধরেই চেষ্টা করে আসছেন পরিশোধন কারখানার মালিকরা। শুধু তেল নয়, আরও কিছু নিত্যপণ্যের দামে বাড়তির টোকা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক উত্তাপে আড়াল হয়ে যাচ্ছে দ্রব্যমূল্য ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি। চাপা পড়ে যাচ্ছে গণমানুষের সংকট। বাজারে জিনিস নেই, তাই দাম বাড়ছে—এ ধরনের বাহানা শুনে মানুষ অভ্যস্ত। কিন্তু বাজারে পর্যাপ্ত জিনিস থাকার পরও দাম বাড়ছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কোথাও।
বাজার-মাজার, রাজনীতির মাঠ-ময়দান সবখানেই সরকারকে এবং মানুষকে পেয়ে বসার একটা মওকা বেশ জোরদার। রাজনীতিতে তা আরও বেগবান। যে যেদিক দিয়ে পারছে শিকার করছে। ঘাড় চেপে ধরছে। ঘাড় বরাবর ধরতে না পারলেও চাতুরীতে কাবু করছে। বিএনপির মতো বিশাল দলকেও ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে। সামর্থ্যে যার যতটুকু কুলায় বলে ফেলছে। পেয়ে বসার প্রশ্নে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না সেনাবাহিনীকেও। তাও যখন আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পরিবর্তিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে, যেখানে তাদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কঠোরভাবে সংরক্ষিত। অন্যদিকে পাকিস্তান, তুরস্ক বা মিশরের মতো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ এখনো রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি মধ্যবর্তী পথে হাঁটছে। এখানে তারা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ভরসার নাম।
এমন এক সময়ে সামনে একটি নির্বাচন, যখন ভোটের সংস্কৃতি বরবাদের হোতাদের বিচার চলছে। তাই সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উচ্চাশা এবার ব্যাপক। শুধু নির্বাচন নয়, ভালো কিছুর জন্য মানুষের মধ্যে সেনাবাহিনীকে পাশে পাওয়ার এক তাড়না কাজ করে। সেনাবাহিনীর অধীনে নির্বাচনের কথা অনেকবার এসেছে। সেখানেও একটা ফের থাকে। বিরোধী দলে থাকলে এ দাবি যত জোর দিয়ে উচ্চারণ হয়, সরকারে গেলে কথা ও সুর বদলে যায়। আবার বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন যত না ‘রেওয়াজ’, তার চেয়ে বেশি ‘প্রয়োজন’। এবারের প্রেক্ষিত ভিন্ন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করার ইতিহাস তৈরি হয়েছে চব্বিশের গণআন্দোলনের চূড়ান্ত বা মোক্ষম সময়ে। দেশের এবারের সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে আছে সেনাবাহিনী। আর আছে বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা বিবেকবানরা উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে। মাদক কারবার ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা-পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারের পুলিশি কাজও করে চলছে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বসভার সদস্যদের প্রতিক্রিয়ায়ও।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর এখন সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর অভিযাত্রার আকাঙ্ক্ষার কথা উঠে এসেছে। তাই পাশে, কাছে, তত্ত্বাবধানে, সহযোগে, সম্পূরকে যেভাবেই হোক; সেনা সম্পৃক্ততায় একটি অবাধ-প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। ঠিক এরকম সময়ে সেনাবাহিনীকে বিব্রত করা, চটানোর একটি ক্রিয়াকর্ম লক্ষণীয়। সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে নিত্যনতুন গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আচানক-আজগুবি, রাতের ঘুম নষ্ট করা গুজবের হাট। গত রাতে সেনানিবাসে ছোটখাটো ক্যু একটা হয়ে গেছে, সামনে বড় রকমের একটা হবে, সেনাপ্রধানকে ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর গেটসহ বিভিন্ন জায়গা দিয়ে ট্যাংক বেরিয়ে পড়েছে—এ ধরনের তথ্য রটাতেও কমতি করা হচ্ছে না। সরকার, সেনাবাহিনীসহ পরিস্থিতি বিবেচনায় সমঝে চলা শক্তির সহনীয় মনোভাবের সুযোগটা এরা কুকাজে লাগাচ্ছে। দায়িত্ববান রাজনৈতিক দলগুলো এতে দায়ী না হলেও দায় রয়েছে ভূমিকা রাখার।
শেখ হাসিনার পতন এবং পলায়ন-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে তাদের মতো করে আন্তরিকতা দেখিয়েছে। সংস্কারের পরিমাণ, ব্যাপ্তি এবং সেটার বাস্তবায়নের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধও চলেছে। সেটি এখন তীব্র পর্যায়ে। এ বিতর্ক ঐকমত্য কমিশন মাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মাঠে-ময়দানেও। চলছে রাজনৈতিক কর্মসূচিও। এবারই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট অনুষ্ঠান করার দাবিতে জামায়াতে ইসলামী এবং কিছু ইসলামী দল মাঠে জনসমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করছে। এ পর্যায়ে এসে মুখ খুলে একটি কঠিন কথা বলেছেন কম কথার মানুষ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে সবাই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে যেন নির্বাচন করতে না পারে। দেশ বাঁচাতে জনগণ আগে নির্বাচন চায়। অথচ কিছু দল নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে। একটু দেরিতে হলেও এমন প্রতিক্রিয়ায় অল্প কথায় অনেক কথা জানিয়ে দিলেন তিনি। মাঠের নেতা ও মাঠের দলের মহাসচিব হিসেবে তিনি বলতে পেরেছেন। কিন্তু সরকারের দিক থেকে এভাবে বলার সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীর পক্ষে তো বলা সম্ভবই নয়। এরপরও সেনা সদরের সেদিনের ব্রিফিংয়ে কোমলে-কুসুমে কমও বলা হয়নি। জুলাই ঐক্য নষ্ট হলে কী হতে পারে—সেই বার্তা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তো দিয়ে রেখেছেন সেই কবেই।
জুলাই ঐক্য নষ্ট হলে কপালে খারাবি আছে; সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজনৈতিক দলগুলোকে মেসেজটি দিয়ে রেখেছিলেন একদম নরমে-গরমে ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউডে। ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ সেনা দিবসে ‘রাওয়া’ আয়োজিত স্মরণসভায় তার সেই বক্তব্য ঘটনা, সময় এবং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। সেখানে তিনি সতর্ক-সাবধান-হুঁশিয়ারি যে ভাষাতেই হোক, সময়োচিত দশ কথার কয়েকটি বলতে ছাড়েননি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছেন। নির্বাচনের কথাও বলেছেন। নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই তাও জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে চায়ের দোকানেও আলোচনার ঝড় ওঠে। বক্তব্যে কয়েকবার ‘সতর্ক’ শব্দের ব্যবহার করেছেন। খোলাসা করে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি।’ বক্তব্যের আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘আমার উপদেশ গ্রহণ করলে আপনারা লাভবান হবেন, এটা আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি।’ নিজেদের মধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, নইলে নিজের ক্ষতি হবে। তখন যেন তাকে দোষারোপ করা না হয়, তা আগাম বলে দিয়েছিলেন। তার ভাষায়—‘নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি, হানাহানি বাদ দিয়ে একসঙ্গে ইউনাইটেড হয়ে কাজ করতে হবে। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন সতর্ক করা হয়নি!’
সতর্কতা-সাবধানতা, হুমকি বা হুঁশিয়ারি, যে যেভাবেই নেন; জেনারেল ওয়াকার কথার বাকি রাখেননি। তার ওই কঠিন উচ্চারণের মাঝে সময়ের ব্যবধানে এখন কারও কারও মধ্যে বোধহীনতার লক্ষণ। বড় দল বিএনপির মাঝে বাস্তবতা মেনে নেওয়ার একটি প্রবণতা বিদ্যমান। জামায়াতে ইসলামী অবুঝ দল নয়। দেশ-বিদেশ, ভেতর-বাইরে, উত্তর-দক্ষিণ সব দিকের তথ্যে তারা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অগ্রগামী। জুলাই বিপ্লবের ফ্রন্টলাইনারদের দল এনসিপিও কম নয়। কিন্তু তাদের বচন-বাচন এবং তৎপরতায় প্রায়ই ঐক্য বরবাদের নমুনা। সরকার এখানে সবার। এ সরকারের নিয়োগকর্তা বা মাস্টারমাইন্ডও সবাই। এ প্রশ্নে সরকার কমবেশি সবার প্রতিই কোমল।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন