

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথিত ‘গাজা শান্তি পরিকল্পনা’ গ্রহণ করল, তখন বহু পর্যবেক্ষক একে যুক্তরাষ্ট্রকে অথবা ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পকে গাজা ও তার জনগণের নতুন ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সমতুল্য বলে বর্ণনা করেছেন। ট্রাম্প প্রথম গাজা সম্পর্কে তার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন গত ফেব্রুয়ারিতে, যেখানে তিনি পুরো গাজা উপত্যকাকে একটি মার্কিন বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে দখল নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ পরিকল্পনায় পুরো ফিলিস্তিনি জনগণকে গাজা থেকে উচ্ছেদ করে অঞ্চলটিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ বানানোর কথা বলা হয়েছিল; যা প্রো-ইসরায়েলি সিএনএন পর্যন্ত ‘২১শ শতকের ঔপনিবেশিকতা’ বলে আখ্যা দেয়।
আন্তর্জাতিক নিন্দার পর, জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তারা এর সবচেয়ে স্পষ্ট ধারাগুলো থেকে সরে দাঁড়ালেও দাবি করে যে, সেখানে কোনো মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে না এবং জনসংখ্যা স্থানান্তর হবে ‘অস্থায়ী’। কিন্তু ট্রাম্প নিজে দ্রুত আবারও পরিকল্পনাটি সমর্থন করেন। খবর অনুসারে, গাজার ওপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ আরোপে তিনি ‘দ্বিগুণ জোর’ দেন। কয়েক মাস পর জাতিসংঘে তার নতুন ম্যান্ডেট সেই মূল প্রস্তাবটিকেই ‘শান্তি পরিকল্পনা’র ছদ্মবেশে পুনরাবৃত্তি করেছে। গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে বসানোর এ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে নানা আরব ও মুসলিম সরকার, যারা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে বিরত থেকে এমন বার্তাই দিয়েছে যে, ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে তারা খুব একটা মাথাব্যথা অনুভব করছে না। তবে এ ব্যবস্থাটি মোটেও অভূতপূর্ব নয়। এটি ফিলিস্তিনিদের ভূমিকে উপনিবেশ বানানোর দীর্ঘদিনের মার্কিন প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা, যার সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে।
আমেরিকান ক্রুসেড: আমেরিকান মিশনারিদের ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়েছিল ১৮২১ সালে। কিন্তু ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করেন। পরে ব্রিটিশ প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে না পেরে তারা সিরিয়া ও লেবাননে চলে যান। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের ফিলিস্তিন পুনর্দখলের পুনরুজ্জীবিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমান্তরালে, আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট মিলেনারিয়ানরাও তথাকথিত ‘শান্তিপূর্ণ ক্রুসেড’-এ যোগ দেন। তারা যিশুর পুনরাগমনের অপেক্ষায় জাফায় কৃষিভিত্তিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেন। তারা চেষ্টা করেছিল সম্প্রতি ফিলিস্তিনে আসা কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ লিথুনিয়ার ইহুদিকে ধর্মান্তরিত করতে এবং তাদের কৃষিকাজ শেখাতে। তবে তারা ওই ইহুদিদের ‘আলসে’ ও ধর্মান্তরে অনিচ্ছুক বলে মনে করে।
১৮৫১ সালে আমেরিকান সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্টদের (মিলারাইট) একটি দল বেথলেহেমে বসতি স্থাপন করে, যেখানে আরতাস নামের কাছাকাছি গ্রামে ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরাও বসতি গড়ে তুলেছিল। পরে তারা জাফায় চলে যায় এবং সেখানে স্বল্পস্থায়ী ‘মাউন্ট হোপ’ কলোনি প্রতিষ্ঠা করে।
আরেকটি দল, ডিকসন পরিবার, ১৮৫৪ সালে জাফায় ‘আমেরিকান মিশন কলোনি’ স্থাপন করে, যা স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ১৮৫৮ সালে কলোনিটিতে হামলা হলে কয়েকজন নিহত হয় এবং বেঁচে যাওয়া সদস্যদের ম্যাসাচুসেটসে ফেরত পাঠানো হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধজাহাজ USS Wabash ফিলিস্তিন উপকূলে পাঠায়, যাতে ওসমানীয় কর্তৃপক্ষ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। ১৮৬৬ সালে, মেইন থেকে আসা একদল আমেরিকান মিলেনারিয়ান কারিগর ও কৃষক জাফায় আরেকটি কলোনি স্থাপনের উদ্দেশ্যে পৌঁছায়।
অ্যাডামস কলোনি, যার নামকরণ করা হয়েছিল এর উগ্র খ্রিষ্টান নেতা ও সাবেক মরমন জর্জ ওয়াশিংটন জোশুয়া অ্যাডামসের নামে। এর সদস্য ছিল ১৫৬ জন। তবে এটি বেশি দিন টেকেনি। অ্যাডামস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওসমানীয়দের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সাহায্য চেয়েছিলেন এবং ফিলিস্তিন উপনিবেশ স্থাপনকে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব উপনিবেশায়নের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ফিলিস্তিনিরা এ উপনিবেশ স্থাপনের বিরোধিতা করে, ফলে ওসমানীয় সরকার কনস্টান্টিনোপলে নিযুক্ত মার্কিন দূতকে অভিযোগ জানায় যে, ‘ইয়াঙ্কি বসতি স্থাপনকারীরা স্থানীয় মানুষদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে।’
অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ব্যর্থতার কারণে দুই বছর পর অ্যাডামসকে কলোনি গুটিয়ে নিতে হয়। শুরুতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তার কলোনি ইহুদিদের ‘ফিরে আসা’র জন্য ভূমি প্রস্তুত করবে, যা খ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমনের পথ ত্বরান্বিত করবে। কলোনি ভেঙে যাওয়ার পর মাত্র ২৬ জন আমেরিকান বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনে থেকে যায়।
ফিলিস্তিনে উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী শেষ ইভাঞ্জেলিক্যাল প্রোটেস্ট্যান্ট আমেরিকানরা আসে ১৮৮১ সালে, যখন শিকাগোর হোরেশিও ও আন্না স্প্যাফোর্ড ১৬ জন উপনিবেশকারীকে নিয়ে ‘দ্বিতীয় আগমন’ ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে ফিলিস্তিনে যান। ১৮৯৬ সালে আরও ৫৫ জন সুইডিশ মৌলবাদী প্রোটেস্ট্যান্ট তাদের সঙ্গে যোগ দেয়, ফলে শতকের শুরুতে উপনিবেশকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০ জনে। আগের প্রচেষ্টাগুলোর বিপরীতে, এ উপনিবেশটি ১৯৫০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত টিকেছিল।
আমেরিকান ম্যান্ডেট: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ফিলিস্তিনকে ঔপনিবেশিক ম্যান্ডেট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার নতুন প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৯১৯ সালের জুনে, প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের পাঠানো কিং-ক্রেন কমিশন আনাতোলিয়া, সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনের জনগণের অভিমত জানার উদ্দেশ্যে ওই অঞ্চলগুলোতে পৌঁছায়। এর লক্ষ্য ছিল ব্রিটেন-ফ্রান্সের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা প্রশমিত করা। ফিলিস্তিনে কমিশনের সদস্যরা মুসলিম-খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের বহু সদস্যের সাক্ষাৎকার নেন, যা যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও জায়নিস্ট বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে গঠিত হয়েছিল এবং ১৯১৪ সালের আগেই ফিলিস্তিনিরা যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছিল তাদেরও সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
সবাই স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন। বিশেষ করে তরুণ ফিলিস্তিনি দেশপ্রেমিকরা স্বাধীনতা এবং সিরিয়ার সঙ্গে একীকরণের পক্ষে মত দেন। সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রতিটি ফিলিস্তিনি জায়নিস্ট বসতি-উপনিবেশায়নের তীব্র বিরোধিতা করেন। কমিশনটি ১৯১৯ সালের আগস্টে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিস্তিনের মানুষ স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। তবে এতে আরও উল্লেখ করা হয় যে তারা ‘এখনো প্রস্তুত নয়’ এবং ব্রিটিশ বা ফরাসি শাসনের চেয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পরিষদসহ একটি মার্কিন ম্যান্ডেটকে দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে পছন্দ করে।
যাই হোক, প্রতিবেদনটি সম্পন্ন হওয়ার আগেই ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে আলাদা সমঝোতায় পৌঁছে যায় এবং এর সুপারিশ উপেক্ষা করে। উইলসনও একই আচরণ করেন। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বেলফোর ঘোষণা সমর্থন করার পর। ফিলিস্তিনে আমেরিকান ভূমিকার সম্ভাবনা জায়নিস্টদের আতঙ্কিত করেছিল, কারণ এতে ফিলিস্তিনিরা ব্রিটিশদের পরিকল্পিত স্বৈরাচারী শাসনের বদলে গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত হওয়ার সুযোগ পেতে পারত। তাই জায়নিস্ট সংগঠন কড়া আপত্তি জানায়, আমেরিকায় গণতন্ত্র সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন বোঝায়, যেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, সভ্যতার ভিন্ন স্তর কিংবা গুণগত পার্থক্য যথেষ্ট বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ গণতন্ত্রকে অনেক সময় ‘মেল্টিং পট’ বলা হয়, যেখানে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। আমেরিকার প্রেক্ষাপটে এটি স্বাভাবিক এবং মোটের ওপর কার্যকর।
কিন্তু এ ধারণাটি যদি মার্কিন প্রশাসন ফিলিস্তিনে প্রয়োগ করে, তাহলে কী হবে? ফিলিস্তিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো আরব, ইহুদি নয়। গুণগতভাবে ইহুদিরা বর্তমানে ফিলিস্তিনে প্রভাবশালী এবং সঠিক পরিবেশ পেলে এক-দুই প্রজন্মের মধ্যেই সংখ্যায়ও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি এই অপরিশোধিত গণনার ভিত্তিতে গণতন্ত্র এখন অথবা নিকট ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে শাসনক্ষমতা আরব সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে থাকবে এবং একটি ‘মহান ইহুদি ফিলিস্তিন’ প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের কাজ অসীমভাবে কঠিন হয়ে পড়বে। এখানে লক্ষণীয় যে, জায়নিস্টরা ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তথাকথিত এই ‘গণতন্ত্রে’ নেটিভ আমেরিকান, আফ্রিকান-আমেরিকানসহ বহু বর্ণগতভাবে ‘নীচু’ বলে বিবেচিত জনগোষ্ঠীকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি উইলসন নিজেও ছিলেন প্রকাশ্যে বর্ণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী।
শেষ পর্যন্ত আমেরিকান ম্যান্ডেট বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে যে ভোটে ফিলিস্তিনকে ইউরোপীয় ইহুদি বসতি স্থাপনকারী এবং স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভাগ করা হয়, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরিতে ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই ভূমিকা। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল ঘোষিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রই তাৎক্ষণিকভাবে তাকে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৬৭ সাল থেকে দেশটির প্রধান সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়।
লিওপোল্ডীয় আকাঙ্ক্ষা: ফিলিস্তিনে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ঔপনিবেশিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু বিস্তৃত আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার ওপরই দাঁড়িয়ে নেই; এর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত রয়েছে তার ব্যক্তিগত কর্তৃত্বও। ট্রাম্প নিজেকে গাজার জন্য গঠিত তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছেন। এ বোর্ডই দুই বছরের জন্য গাজার অস্থায়ী প্রশাসন চালাবে, যেখানে থাকবে বহুজাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী, ফিলিস্তিনি প্রযুক্তিবিদদের কমিটি এবং একটি স্থানীয় পুলিশ বাহিনী।
ট্রাম্প টনি ব্লেয়ারকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যিনি আরববিশ্বে অত্যন্ত অজনপ্রিয়, ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণে ভূমিকার জন্য বহু মানুষের কাছে ‘যুদ্ধাপরাধী’, যদিও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাকে সমর্থন করে। ব্লেয়ার সম্প্রতি দখলকৃত পশ্চিম তীরে গিয়ে মাহমুদ আব্বাসের মনোনীত উত্তরসূরি হুসেইন আল-শেখের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যাতে গাজায় ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। ট্রাম্পের ম্যান্ডেটে বলা হয়েছে যে তিনি ‘পুরো পরিকল্পনা সমর্থন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় যে কোনো অতিরিক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন’।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নিউইয়র্ক কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক ক্রেইগ মোকহিবার ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের ভূমিকার তুলনা করেছেন কঙ্গোর বেলজিয়ান রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের সঙ্গে। এ তুলনা ভুল নয়। বেলজিয়ামের তৎকালীন অপেক্ষাকৃত নবীন রাজা লিওপোল্ড দ্বিতীয় ‘কমিটি ফর দ্য স্টাডিজ অব দ্য আপার কঙ্গো’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য কঙ্গো’ নামে পরিচিত হয়—উদ্দেশ্য ছিল মধ্য আফ্রিকার এ অঞ্চলটি উপনিবেশ বানানো। বার্লিন সম্মেলনে তিনি এ অধিকার অর্জন করেন। এর মাধ্যমে তিনি ১৮৮৫ সালে ‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট’কে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। লিওপোল্ডের উপনিবেশবাদ কঙ্গোর জনগণকে নির্মম জবরদস্তি, শ্রমদাসত্ব ও সম্পদ লুটের শিকার করে। জনগণের প্রতিরোধের জবাব দেওয়া হয় গণহত্যামূলক সহিংসতায়, যাতে প্রায় এক কোটি মানুষ নিহত হয়, যা তখনকার কঙ্গোর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
লিওপোল্ডের নৃশংসতার ভয়াবহতায় অন্তর্ভুক্ত ছিল শ্রমদানে ব্যর্থতা বা ‘অবাধ্যতা’র শাস্তি হিসেবে অসংখ্য কঙ্গোবাসীর হাত কেটে ফেলা। কঙ্গো ছিল একটি ক্ষুদ্র বসতি-উপনিবেশও, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রায় ২৫ হাজার শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারী বাস করত।
আগামী দিনে কী অপেক্ষা করছে: গাজায় গণহত্যার পর ফিলিস্তিনিদের জন্য ট্রাম্পের পরিকল্পনা এখনো অস্পষ্ট। কারণ, জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি বহুবার তাদের উচ্ছেদের আহ্বান জানিয়েছেন এবং সাম্প্রতিক ইসরায়েলি প্রচেষ্টা, যেখানে ফিলিস্তিনিদের ‘রহস্যময়’ ফ্লাইটে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হচ্ছে, এ উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
যদি এটাই তার ঘোষিত ‘যুদ্ধবিরতি’র বাস্তব রূপ হয়, যে সময়ে ইসরায়েল প্রতিদিন বোমা হামলা চালিয়ে আরও অন্তত ৩৪৭ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, পাশাপাশি পশ্চিম তীর, দক্ষিণ লেবানন ও সিরিয়ায়ও হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে তার প্রত্যক্ষ শাসনে ‘শান্তি’ কেমন হবে, তা ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। গত দুই বছরে গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের (এবং ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের) সক্রিয় অংশগ্রহণ, যা এখনো থামেনি। এটা ইঙ্গিত করে যে, তাদের সামনে যে ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে, তা হয়তো কঙ্গোতে রাজা লিওপোল্ডের শাসনে কঙ্গোবাসীদের যে পরিণতি হয়েছিল, তার থেকে খুব আলাদা নাও হতে পারে। গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ছয় হাজারজনের অন্তত একটি করে অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে চার হাজার শিশু। ২০০৬ সালের পর থেকে ইসরায়েলের একের পর এক আগ্রাসন ও বোমাবর্ষণে যাদের অঙ্গ হারাতে হয়েছিল, সেই সংখ্যার সঙ্গেই এটি যুক্ত হলো।
লিওপোল্ড এবং ইসরায়েলের অতীত নৃশংসতার ধারাবাহিকতায় গাজার ফিলিস্তিনিরা ট্রাম্পের অধীনে আরও বেশি অঙ্গচ্ছেদের শিকার হবেন কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কঙ্গোতে যেখানে লিওপোল্ডের লক্ষ্য ছিল রাবার লুট করা, ফিলিস্তিনে ট্রাম্পের আগ্রহ রিয়েল-এস্টেট ধরনের ‘রিভিয়েরা’ প্রকল্পই শুধু নয়—বরং গাজার তেল ও সমুদ্রের অফশোর গ্যাস সম্পদেও। তথাকথিত এই ‘শান্তি’ প্রহসনের সঙ্গে এখন জাতিসংঘের নামও জুড়েছে। এই প্রহসন সম্পন্ন করতে এখন একমাত্র প্রতিবন্ধক হচ্ছে গাজার ফিলিস্তিনিদের অব্যাহত সংগ্রাম ও অটল মনোবল। ইসরায়েলের দুই বছরেরও বেশি সময়ের বর্বরতার মধ্যেও তাদের দৃঢ়তা এক বিন্দুও কমেনি।
লেখক: নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক আরব রাজনীতি ও বৌদ্ধিক ইতিহাসের অধ্যাপক। মিডল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন আবিদ আজাদ
মন্তব্য করুন