

গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ‘ঢেঁকি’। একসময় এর ছন্দোময় শব্দে মুখরিত থাকত গ্রাম-মহল্লা। কিন্তু যন্ত্রচালিত কলের দাপটে সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখন প্রায় বিলুপ্ত। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার করে প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে আবার আধুনিক রূপে ফিরিয়ে এনেছেন অনেকেই। তবে পারিবারিকভাবে নয়, বরং ব্যবসায়িক আকারে।
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলাধীন নালী ইউনিয়নের কুন্দুরিয়া গ্রামে এমনই এক আধুনিক ঢেঁকির সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তা মো. আক্তার হোসেন স্থাপন করেছেন এই ঢেঁকি, যা যেন ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির এক চমৎকার মেলবন্ধন।
সরেজমিন কুন্দুরিয়া গ্রামের অবাক মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুতের মাধ্যমে মোটরের সাহায্যে দুটি কাঠের ঢেঁকি সচল রয়েছে। ৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এই ইলেকট্রনিক ঢেঁকিগুলোতে ৪ হর্স পাওয়ারের মোটর যন্ত্রাংশের সঙ্গে যুক্ত করে বসানো হয়েছে কাঠের ঢেঁকি। পাশেই মনোয়ারা বেগম নামে একজন নারী শ্রমিক সনাতন পদ্ধতিতে কুলা দিয়ে ঢেঁকি ছাঁটা চালগুলো পরিষ্কার করছেন। এখানে উৎকৃষ্ট মানের আমন ও আউশ ধানের লাল চাল প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে।
উদ্যোক্তা আক্তার হোসেন জানান, প্রতিদিন তার এই আধুনিক ঢেঁকিতে ৪ থেকে ৫ মণ ধান ভানা হয়। এরই মধ্যে তিনি অনলাইনের মাধ্যমে ঢেঁকি ছাঁটা চাল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দিচ্ছেন। তিনি উল্লেখ করেন, দিন দিন ঢেঁকি ছাঁটা চালের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে।
ঢেঁকি ছাঁটা চাল কিনতে আসা পার্শ্ববর্তী গ্রামের মো. শিপন মিয়া বলেন, ‘বাজারে ঢেঁকি ছাঁটা চাল পাওয়া খুবই দুষ্কর। তাই পরিবারের জন্য প্রথমবারের মতো ৫ কেজির একটি চালের প্যাকেট নিলাম। ভালো লাগলে পরবর্তীতে বেশি করে কিনব।’ তিনি প্রযুক্তির মাধ্যমে আধুনিক ঢেঁকি ফিরিয়ে আনার এই উদ্যোগকে উদ্যোক্তার অনন্য প্রচেষ্টা বলে প্রশংসা করেন।
উদ্যোক্তা আক্তার হোসেন জানান, ২০২০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তার তাকে ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু বাজারে এই চাল না পেয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে যশোরের ঢেঁকি ছাঁটা চালের সন্ধান পান। পরে ২০২৪ সালে নিজেই যশোর থেকে মেশিন কিনে নিয়ে আসেন। ঢেঁকি ছাঁটা চালের ব্যাপক চাহিদা দেখে তিনি বিক্রির উদ্দেশ্যে তার মার্কেটে দুটি আধুনিক ঢেঁকি স্থাপন করেন।
বর্তমানে তার ঢেঁকি ছাঁটা চাল ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। নিজ জেলার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই এই চাল বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। আক্তার হোসেনের দাবি, বাণিজ্যিকভাবে আধুনিক ঢেঁকি স্থাপনের জন্য সরকারের আর্থিক সহযোগিতা পেলে ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই চাল বাণিজ্যিকভাবে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে ঘিওর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাশিতা-তুল ইসলাম বলেন, ‘ঢেঁকি ছাঁটা চাল আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি অংশ। আক্তার হোসেনের এই আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছি।’
মন্তব্য করুন