মোস্তফা কামাল
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৪৯ এএম
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আটাশ অক্টোবরে এবার কোন শনির ভর

আটাশ অক্টোবরে এবার কোন শনির ভর

সরকারকে ২৮ অক্টোবরের আগে ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে মানে মানে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্য—বিএনপিই পতনের পথে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের বক্তব্য সুনির্দিষ্ট—২৮ অক্টোবরে সরকারের পতন ডাকতে গিয়ে বিএনপিই পতনযাত্রা করবে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের মূল্যায়ন, দেশ এখন গভীর সংকটে। কখন-কোথায় কী ঘটে বসে কেউ জানে না। তিন দলের তিন শীর্ষ নেতার বক্তব্যের মধ্যেই ভয়ের বার্তা বিদ্যমান। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন দুর্গা-উৎসবেও এবার ভয়ের বারতা। এবার দেবী দুর্গার আগমন ও গমন দুটাই ‘ঘোটকী’। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দেবীর ঘোড়ায় চড়ে আগমন ও গমন চরম অশুভ। শঙ্কা করা হয় প্রকৃতি ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগের। তাদের এ বিশ্বাসে অন্যদেরও বিশ্বাস করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে অশুভর শঙ্কা ভর করেছে যথারীতি।

প্রশ্ন এসেই যায়, এবার অক্টোবরে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্বিপাকটি কেমন হতে পারে? ২৮ অক্টোবরইবা এমন কী ঘটবে? এর আগে পদত্যাগ না করলে সরকারি দলকে পালাতে হবে বা তারা পালানোর পথই পাবে না? অথবা সেদিন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো কী ঘটাবে? আর ঘটানোর চেষ্টা করলে মতিঝিলে হেফাজতের পরিণতি বরণ করবে? একসময় হেফাজতের দাবি ছিল তাদের হাজার-হাজার, শত-শত নেতাকর্মীকে অপারেশন সানলাইটে দুনিয়া ছাড়া করে দেওয়া হয়েছে। জবাবে সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছিল, সে ধরনের কিছু হয়নি। সামান্য পিটুনিতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র। এখন তাহলে কেন হেফাজতি পরিণতির ভয় দেখানো? প্রশ্ন থাকলেও জবাব নেই। এর মধ্যেই সরকারি-বেসরকারি, সংসদের বিরোধী দল, রাজপথের বিরোধী দল থেকে এমন সব কথার তীর ছোড়া হচ্ছে, যা মানুষকে আতঙ্কিত না করে পারে না। তার ওপর ২৮ অক্টোবর ডেটলাইনটি ভয়জাগানিয়া। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনীতির কলঙ্কের এক ঘা। সেদিনটি ছিল শনিবার। এবারের ২৮ অক্টোবরও পড়েছে শনিবার।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের শনির আসরে ওয়ান ইলেভেন ত্বরান্বিত হয়েছিল। সেদিন ছিল আওয়ামী লীগের আলোচিত লগি-বৈঠা আন্দোলন বা লগি-বৈঠা র‌্যালি তথা তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ডাকা সমাবেশ। উদ্দেশ্য তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা। সমাবেশের মূল দাবি ছিল, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কথা ছিল, তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি নিয়োগ না দেওয়া। কারণ তিনি কোনো একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ২৮ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছাড়লেও অধ্যাপক রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও মিত্র দলগুলোর অভিযোগ ছিল যে, তিনি বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার নির্দেশে চলছিল। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো ২৮ অক্টোবর এলাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সমাবেশ ডাক দেয়, সেখানে অনেকে লগি-বৈঠা নিয়ে হাজির হয়। শনির ওই দিনটিতে - উত্তর গেটে। লগি-বৈঠার সেই সংঘাতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এরই মধ্যে বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এতে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলোর দাবি রক্ষিত হয়। পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জারি করা হয় জরুরি আইন। রাজনীতির ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করলে এখনো অনেকের চোখে ভাসে সেই কলঙ্কিত ও ভয়াল দিনের ঘটনাগুলো। কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক নানা ঘটনায় শনির একটি চক্কর দৃশ্যমান। তলে তলে নয়, রাজনীতির খেলা গলা উপচে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এবার জাতিসংঘও জানিয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আগের অবস্থানের নড়চড় হয়নি। সেইসঙ্গে, জনগণের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতে ভীতি প্রদর্শন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও পাল্টায়নি ঢাকা সফরের সময় তা নতুন করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন দেশটির উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার। জানতে চেয়েছেন, মার্কিন আগাম নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দেওয়া সংলাপসহ পাঁচ সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকাশ্যে কড়া বার্তা, ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন হবেই।’ তার এ বক্তব্যের মধ্যে ২০১৪ সালের মতো বা একই কায়দায় ভিন্নরূপে নির্বাচনের শঙ্কা ভর করেছে বিএনপির ওপর। ভেতরে-ভেতরে পানি গড়াচ্ছে অন্যদিকে। যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ দফার মধ্যে বল দুদিকেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সরকারের যে বিএনপিকে কোনো দল মানতেই আপত্তি, সেই বিএনপির সঙ্গেই এখন সরকারকে সংলাপ করতে বলছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার বিএনপি যেখানে সরকারকেই অবৈধ বলছে, সেখানে ওই সরকারের সঙ্গেই তাদের বসতে বলা হচ্ছে। স্যাংশন-ভিসা রেসট্রিকশন পর্ব শেষে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণে অতিরিক্ত সতর্কতা জারি করেও রেখেছে। এসবের রসায়নে বাংলাদেশের রাজনীতির টম অ্যান্ড জেরির খেলা আরও জমছে। বাড়ছে আকথা-অপকথার ধুম। যার এক কদাকার শোডাউন হয়েছিল বহুল আলোচিত-সমালোচিত ওয়ান ইলেভেনের আগেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটেনের আনোয়ার চৌধুরী, জাতিসংঘের রেনাটা লক ডেসালিয়ানসহ বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিডর বইয়ে দিয়েছিল। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তারা প্রায়ই বিবৃতি দিতেন। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এডিবিকেও এক করে ফেলেছিলেন তারা। রাজনীতিকরাও ছুটে গেছেন তাদের কাছে। এতে কেউ বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন, কেউ নিগৃহীত হয়েছেন। ২০১৪-১৮-তে ধরন বদলায়। ২০২৩-এ এসে আরও পরিবর্তন। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের এ আকাঙ্ক্ষার পারদ দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশিদেরও কাছেও পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি। যারপরনাই উতলা দেশটি। তাদের এ চাওয়ার রকমফের নিয়ে নানা কথার কচলানির সমান্তরালে প্রশ্নও অনেক। আসল টার্গেটের কথা না বলে তারা বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়েছে ছুতা হিসেবে। মৌসুমদৃষ্টে সামনে আনা হচ্ছে নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতাসহ আনুষঙ্গিক কিছু বিষয়কে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় বাজার। এ হাটের হাটুরা হতে কম-বেশি আগ্রহ সুপার পাওয়ার প্রায় সব দেশেরই। স্বাভাবিকভাবেই এর সরাসরি শিকার ক্ষমতাসীনরা। সরকারের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উতলা না হতে বলা হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বরং নির্বাচন কেমন হয় সেদিকে নজর দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বানও জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা মার্কিন পর্যবেক্ষক দলকে এ আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচন অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। এ ধরনের ওয়াদা ও নিশ্চয়তার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের বাগড়া থামছে না। অবধারিতভাবে বিষয়টি এখন বাংলাদেশ আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নেই। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আরও নানা পক্ষ। যেমনটি হয়েছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের পূর্বাপরেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটেনের আনোয়ার চৌধুরী, জাতিসংঘের রেনাটা লক ডেসালিয়ানসহ বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিডর বইয়ে দিয়েছিল। বিউটেনিস-রেনাটা লকরা তখন সব দিকেই তাড়া দিয়েছেন। ২০০৬ সালের শেষ দিকে এবং ২০০৭ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা দেশের কিছু কূটনৈতিক ছিলেন বেশ তৎপর। রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য তারা দফায় দফায় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছেন। অক্টোবরেই এসপার-ওসপারের গুঞ্জন-গুজব বেশ জোরদার। আলোচনাও জমেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়ক কথামালা বেশি, মেইনস্ট্রিমের মিডিয়ায়ও কম নয়। নতুন কী হয়েছে বা আর কী হওয়ার বাকি আছে—এ প্রশ্নের কিন্তু দিশা বা নিশানা নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই। তথ্য ও প্রশ্ন নিষ্পত্তিহীন রেখেই অক্টোবরবিষয়ক বাজার গরম। ২৮ অক্টোবর আরও প্রাসঙ্গিক। বিএনপি যারপরনাই পুলকিত। এর বিপরীতে সরকারও চাঙ্গা। ভীত না হয়ে ফ্রন্টে আগোয়ান। বিএনপিকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার হুংকার। দুদলেরই আবার পরস্পরকে ‘পালাতে দেওয়া হবে না’, ‘পালানোর পথ পাবে না’ মর্মে কড়া বার্তা। দুই দলের একটিও পালাতে চায় বা পালানোর চিন্তা করছে—এমন কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। কোনো গণমাধ্যমেও কোনো দল বা দলের কারও পালানোর চেষ্টার তথ্য আসেনি। বরং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাহীন বিএনপি দুই দলই তাদের সাংগঠনিক শক্তির জানান দিচ্ছে। মাসটি জুড়ে তাদের শক্তির মহড়া বা শোডাউনের কর্মসূচিও চলছে। তাই বলে অক্টোবরে, এমনকি ২৮ অক্টোবরই ফয়সালা হয়ে যাবে? নির্বাচনের জন্য জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না?

লেখক : ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সৌদিগামী যাত্রীদের জন্য সুখবর

এমবাপ্পের একমাত্র গোলে রিয়ালের কষ্টার্জিত জয়

ম্যানসিটি ছাড়ছেন আর্জেন্টিনার ‘নতুন মেসি’

‘৫১ লাখ টাকার স্টেডিয়াম ১৪ কোটিতে করার অনুমোদন’, কী ব্যাখ্যা দিলেন সচিব

জনপ্রিয় ব্রিটিশ পত্রিকায় বাংলাদেশ নারী দলের প্রশংসা

ইউআরপি ও ডিএলআর মডিউল প্রস্তুত / মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাবে শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে

রাশিয়া শক্তিশালী, এটা মেনে নিতেই হবে : ট্রাম্প

ময়মনসিংহ থেকে বাস চলাচল শুরু, ভাঙচুরের ঘটনায় কমিটি

আইপিএলে ভালো করলেও ভারত দলে জায়গা নিশ্চিত নয়

ফেব্রুয়ারির কত তারিখে রোজা শুরু হতে পারে 

১০

দুই শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকি প্রদানের ঘটনায় আহমাদুল্লাহর উদ্বেগ

১১

সরকারি কর্মচারীরা দাফনের জন্য পাবেন টাকা

১২

দেড় যুগেও নির্মাণ হয়নি জহির রায়হান মিলনায়তন

১৩

দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা, দুই উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি

১৪

৫ অভ্যাসে বার্ধক্যেও ভালো থাকবে হৎপিণ্ড

১৫

অনশন প্রত্যাহার করল বেরোবি শিক্ষার্থীরা

১৬

‘ভুল চিকিৎসায়’ একদিনে দুই শিশুর মৃত্যু

১৭

সরকারি কর্মচারীদের জন্য সুখবর

১৮

কাভার্ডভ্যানের চাপায় মা-মেয়ের মৃত্যু

১৯

মাস্ক পরে হাসপাতালে দীপু মনি

২০
X