সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৩, ০৪:০৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

লড়তে হবে সর্বপ্রকার অপশক্তির বিরুদ্ধে

অলঙ্করণ: আবু হাসান
অলঙ্করণ: আবু হাসান

মানুষ বড়, নাকি মনুষ্যত্ব? মানুষই তো বড়, মনুষ্যত্বের চেয়ে। কিন্তু যদি মানুষের মনুষ্যত্ব না থাকে তবে তো সে আর মানুষই থাকে না। আমরা যে বলি, সে তো মিথ্যা বলি না যে, মনুষ্যত্বহীনতায় মানুষ পশু হয়ে পড়ে। মানুষ পশু হলে পশুর চেয়েও বড় পশু হয়—যেমন আতঙ্কের দিক থেকে, তেমনি নিষ্ঠুরতার দিক থেকে। মানুষের পশুত্ব অস্বাভাবিক পশুত্ব। হয়তো আতঙ্কগ্রস্ত, হয়তো নিষ্ঠুর, হয়তো দুই-ই।

মানুষের নিষ্ঠুরতার দিকটার কথা শিল্প-সাহিত্যে প্রচুর পরিমাণে বলা হয়েছে। মানুষ পশু হয়ে উঠেছে অর্থাৎ হিংস্র, নিষ্ঠুর, বিবেচনাহীন হয়ে পড়েছে—এমন চিত্র জীবনে যেমন পাওয়া যায়, শিল্প-সাহিত্যেও তেমনি পাই। কিন্তু মানুষ তো পশু হয় শুধু নিষ্ঠুরতার দিক দিয়েই নয়, হয় আতঙ্কের, পরাজয়ের, হতাশার দিক থেকেও। যে মানুষ সন্ত্রস্ত, পরাজিত, হতাশ সে মানুষ আর মানুষ নেই, অপরিহার্য মনুষ্যত্ব হারিয়ে সে পশুতে রূপান্তরিত হয়েছে—নিজের অজ্ঞাতেই।

খাঁচার পাখি যেমন পাখি নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে, সন্ত্রস্ত, পরাজিত; হতাশ মানুষও তেমনি মানুষ নয়, যথার্থ অর্থে। এই কথাও, সন্ত্রস্তের এই মনুষ্যত্ব হারানোর কথাও আমাদের শিল্প-সাহিত্যে আছে। কিন্তু যা নেই, খুব করে নেই, যত করে থাকা উচিত ছিল তত নেই, তা হচ্ছে কেমন করে মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে তার বিনষ্ট মনুষ্যত্ব—সেই পথের কথা। দুঃখ আছে, কথা নেই দুঃখ-মোচনের।

মানুষকে ভালোবাসো—এ কথাটা নানাভাবে, বহু বিভিন্ন স্বরে ও সুরে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কখনো, কখনো স্পষ্টাস্পষ্টি, কতবার বলা হয়েছে। কিন্তু কোন সে মানুষ, যে মানুষকে ভালোবাসব আমি? মানুষ যদি খুইয়ে থাকে তার মনুষ্যত্ব, নিপীড়নে ও অভাবে সে যদি হারিয়ে থাকে তার মানুষ পরিচয়, তবে তাকে ভালোবাসব কেমন করে, কীসের তাগিদে, কোন প্রেরণায়? পথের পাশের কুকুরকে দেখে কে করবে অশ্রুপাত? কার হৃদয় দ্রবীভূত হবে শোকে? যাকে ভালোবাসব তাকে অবশ্যই যোগ্য হতে হবে ভালোবাসার এবং যখন যোগ্য হবে পাত্র তখন ভালোবাসা আসবেই, শিখিয়ে দিতে হবে না, পরামর্শের আবশ্যকতা দেখা দেবে না।

প্রেম উপদেশ চায় না, যোগ্য পাত্র চায় মানুষকে, তাই মানুষ করে তোলা চাই আগে। কিন্তু মানুষ করে তোলার অর্থটা কী? আমরা ছেলেমেয়েদের মানুষ করি, অহরহ, প্রতিনিয়ত। বিদ্যালয়ে পাঠাই, সেখানে যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ শিক্ষকরা আছেন, তাদের শক্তিশালী প্রকৌশলী হস্তক্ষেপে ছেলেমেয়েরা মানুষ হয় অর্থাৎ লায়েক হয়। সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে বুর্জোয়া আকাঙ্ক্ষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একটা মূল্যবোধ গড়ে তুলে তারা মানুষ হয়। অর্থাৎ প্রধানত স্বার্থপর এবং হয়তো প্রতারক হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে আসে না, এলেও ঝরে পড়া আমের মুকুলের মতো ঝরে পড়ে। অকালেই শেষ হয়। আম হয় না। হলেও পাকে না। সমাজের ঝড় ও সামাজিক দুর্বৃত্তদের ঢিল খেয়ে ছিঁড়ে ঝরে পড়ে।

এ দুই দলের মধ্যে প্রকৃত মানুষ কই? স্বার্থপর ও প্রতারক তো মানুষ নয়, মনুষ্যত্বের গুণ নেই তার, দুর্বৃত্ত সে, পশু। অন্যদিকে পশুর স্তরে যে জীবনযাপন করছে, সেও তো মানুষ নয়, তাকে আমরা যতই করুণা করি না কেন। ঘাতক অমানুষ করে তুলছে পলাতককে। প্রথম দলের মনুষ্যত্বহীনতা কেড়ে নিচ্ছে দ্বিতীয় দলের মনুষ্যত্ব। এক অমানুষ আরও পাঁচজনকে অমানুষ করে তুলছে। মনুষ্যত্বহীনতা মনুষ্যত্বহীনতার জন্য। দিচ্ছে। এটাই ব্যবস্থা। আজকের নয়, যুগ-যুগান্তরের।

না, মানুষ করার অর্থ একটাই। সরল অর্থ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বকে সুবিকশিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করা। যারা পশু হয়ে উঠেছে হৃদয়হীনতায়, নিষ্ঠুরতায় তাদের মানুষ করতে হবে। অর্থাৎ শাসন করা চাই তাদের, ধমক দেওয়া চাই। সামাজিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা চাই তার পশুত্বকে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, প্রয়োজনীয় বিষয়, যারা মনুষ্যত্ব হারিয়েছে এ পশুদের নিপীড়নে, তাদের প্রতিষ্ঠিত করা মনুষ্যত্বে। দুই কারণে এর গুরুত্ব অধিক।

প্রথমত, মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার হারিয়ে মানুষের চেয়ে নিচু স্তরে নেমে গেছে যারা তাদের সংখ্যাই অধিক, সংখ্যায় তারা অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, নিচের মানুষদের মনুষ্যত্ব ফিরে পাওয়ার সঙ্গে ওপরের মানুষদের পুনরায় মানুষ হওয়া অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত। নিপীড়িত মানুষ উঠে না দাঁড়ালে, ধমক না দিলে নিপীড়নকারী দুর্বৃত্ত নিবৃত্ত হবে না, হয়নি কখনো। গৃহস্থের সতর্কতাই ডাকাতির ওপর সবচেয়ে বড় নিষেধাজ্ঞা।

নিপীড়িত মানুষকে তাই মানুষ করে তোলা চাই। অর্থাৎ তাকে দেওয়া চাই মানবিক অধিকার, জীবনের নিরাপত্তা, জীবিকার নিশ্চয়তা। আহার দিতে হবে, দিতে হবে বাসস্থান। কিন্তু শুধু বাঁচা তো নয়, মানুষের মতো বাঁচা, বেঁচে থাকা তো শুধু টিকে থাকা নয়। গাছ, মাছ, কীটপতঙ্গ টিকে থাকে, বেঁচে থাকে না। মানুষের মতো বাঁচার অর্থ স্বাধীনতা নিয়ে, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচা। স্বাধীনতা কথা বলার, মতামত প্রকাশের, সংগঠন গড়ার, চলাফেরার, দেশের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের। বোবা, অক্ষম, খঞ্জ মানুষ মানুষও নয়, পশুও নয়, সে মানুষের বিকৃত, নয়তো ব্যঙ্গচিত্র। এ কথাও সর্বদা স্মরণ রাখা বোধকরি কর্তব্য যে, স্বাধীনতা এক ও অবিভাজ্য।

স্বাধীনতা শুধু যে দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তে রক্ষিত পরীক্ষিত হয় তা কখনো নয়, তার রক্ষা ও পরীক্ষার কাজ দেশের প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে অবিরাম চলতে থাকে, সর্বক্ষণ। মানুষের জীবনে যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকে, অভাব থাকে রাজনৈতিক অধিকারের, তবে স্বাধীনতা আছে এ কথা যতই বলা যাক না কেন, বাস্তবে সে দাবি সত্য হবে না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথাও উল্লেখ করা যায় এ প্রসঙ্গে। এ স্বাধীনতা সংবাদপত্রের মালিকদের অধিকার নয়, শুধু সাংবাদিকদেরও ব্যাপার নয়, এই স্বাধীনতার প্রয়োজন দেশের সব মানুষের জন্যই।

একদা রামমোহন রায় ইংরেজ সরকারের কাছে দেনদরবার করেছিলেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য। তারপর কত সরকার এলো, গেল, দেনদরবার বিক্ষোভে পরিণত হলো, কিন্তু কই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তো আজও অর্জিত হলো না। এক স্বাধীনতা অন্য স্বাধীনতার অভাবের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। স্বাধীনতার অভাব দুঃখের ব্যাপার। কিন্তু তার চেয়েও বড় দুঃখের ব্যাপার আছে। সে হলো অভাববোধের অভাব। অভাব যত না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে অভাববোধের অভাব।

অভাব সাংস্কৃতিক চেতনার ব্যাপার। সংস্কৃতি নিয়ে গৌরব, উচ্চকথন, হট্টগোল ইত্যাকার ব্যাপার অনেক করেছি, আজও করছি। কিন্তু এই যে স্বদেশি সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা; এদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের যত বড়াই করি না কেন, এদের অভ্যন্তরে কী আছে? পোশাকের অভ্যন্তরের চরিত্রটা কী?

সেই চরিত্রের দিকে তাকালে অন্তঃসারশূন্যতার বড় বড় গর্তই চোখে পড়বে নানা স্থানে। অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব নেই, শুধু সমন্বয়ের কথাই অধিকাংশ সময়ে কোমল সুরে, কখনোবা উচ্চকণ্ঠে বলা হয়েছে। অভ্যন্তরে সংস্থাপিত বুদ্ধিবৃত্তিক তথা দার্শনিক চিন্তার স্তরটি উদ্বেগজনকরূপে সামান্য। একদা রবীন্দ্রনাথ এক ঔপন্যাসিককে বলেছিলেন এই কথা, “আপনি কোন রকম ঐতিহাসিক বা উপদেশিক বিড়ম্বনার মধ্যে যাবেন না এবং শীতল ছায়া, আম কাঁঠালের বন, পুকুরের পাড়, কোকিলের ডাক, শান্তিময় প্রভাত এবং সন্ধ্যা, এরই মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে তরল কলধ্বনি তুলে বিরহমিলন হাসিকান্না নিয়ে যে মানব জীবনস্রোত অবিশ্রান্ত প্রবাহিত হচ্ছে তাই আপনি আপনার ছবির মধ্যে আনবেন।”

এই ছবির বর্ণনাও ছবি একটা, সুন্দর ছবি। কিন্তু কোন চেতনার কথা আছে এই সুন্দর করে তুলে ধরা চিত্রের ভেতরে? এই জীবনস্রোত অবিশ্রান্ত বটে, কিন্তু সে তো ‘প্রচ্ছন্ন’ শুধু, কেবলি তরল কলধ্বনি তোলা, প্রাকৃতিক দৃশ্যের অংশ শুধু। এই বর্ণনায় যে জীবনের আদর্শ প্রতিফলিত সে জীবন মানুষের নয়। সে জীবনে মানুষের জীবন নেই, গাছগাছড়া পশুপাখি, কীট-পতঙ্গের মতো কোনোমতে টিকে থাকা আছে শুধু।

রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণনা নিঃসন্দেহে প্রতিনিধিত্বমূলক। এর পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সেটাই প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি। স্মরণযোগ্য এই সত্যও যে, রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সাহিত্যে প্রকৃতির ওপর মানুষের যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংবাদ পরিবেশিত, তা সবসময় সমর্থন করেননি, তার স্বাভাবিক সমর্থন প্রকৃতি ও মানুষের প্রাচ্য-দেশীয় ঐক্যের প্রতি।

তাহলে মূল কথা হচ্ছে, দ্বন্দ্বে যাব না, খুঁজব সমন্বয়। কেন আসে না দ্বন্দ্ব? আসে না মানুষের জীবন সম্পর্কে উন্নত চিন্তা নেই বলে। মনুষ্যত্বের প্রশ্ন, অর্থাৎ মানুষের মতো বাঁচার অধিকারের প্রশ্নে যে কোনো আপস নেই, সেই দাবিতে যে অনড় থাকবে, লড়বে প্রতিনিয়ত—এ বোধের অভাবই দ্বন্দ্ব-ভীরুতার জন্ম দেয়, সমর্থন জোগায় সমন্বয় পন্থার, আপসকামিতার, সুবিধাবাদিতার। নইলে দেখা যেত জীবনযাত্রার ক্ষণে ক্ষণে, পদে পদে দ্বন্দ্ব বাধছে প্রকৃতির সঙ্গে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গে, শাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। দেখা যেত, সেই দ্বন্দ্বে জীবনের মানদণ্ডে গুণগত পরিবর্তন আসছে। শত শত বছরের সঞ্চিত গ্লানি ও দারিদ্র্য দূর হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু অভাববোধ প্রবলভাবে আসেনি। অভাববোধ ছাড়া মানুষ যে মানুষই নয়, মনুষ্যত্বহীনতার সেই চেতনা এবং মনুষ্যত্বহীনতার প্রতি ক্ষমাহীন ঘৃণা গড়ে ওঠেনি সংবিতে। তাই তো দেখি অধিকার আজও বিকাশের বিষয় যতটা না, তার চেয়ে বেশি অর্জনের বিষয় হয়ে আছে। তাই তো দেখি নিষ্পিষ্ট মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য-যন্ত্রণা নিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্তসুগত প্রচুর করুণা-প্রকাশ ও অপ্রপাত ঘটে, কিন্তু প্রতিকারের অভীষ্ট লক্ষ্য ও বাস্তব উপায় সম্পর্কে খুব কম বলা হয়। ভিক্ষা দেওয়া হয়, ভিক্ষাবৃত্তির কুফল বিষয়েও আলোকপাত করা হয়, কিন্তু যা হয় না তা হচ্ছে, ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের কার্যকর সামাজিক-অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ। সমালোচনা থাকে, প্রতিবাদ থাকে না।

যে শ্রেণির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সংস্কৃতিতে তথা সমাজে, সেই শ্রেণি দ্বন্দ্ব চায় না। তারা স্বাধীনতার সুখ চায় না, কোনোমতে টিকে থাকার স্বস্তি চায়। সহযোগিতায়, সমঝোতার ও সরাসরি তোষণের পথ ধরে হাঁটি হাঁটি পা-পা অগ্রসর হয়ে জাগতিক বিত্তবৈভবের পুঁজি স্ফীত থেকে স্ফীততর করতে চায়। ভয় পায় বিরোধের পথকে। এই চরিত্র কারও ব্যক্তিগত নয়, এই চরিত্র শ্রেণিগত। আমাদের দেশি মধ্যবিত্ত ইউরোপের বুর্জোয়াদের মতো সামন্তবাদের আনুগত্যবন্ধন ছিন্ন করে বিদ্রোহী হিসেবে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার নিশান উড়িয়ে সদর রাস্তা ধরে কুচকাওয়াজ করে আসেনি, তারা এসেছে গোপন পথে, অন্ধকারে দালালির নিজস্ব নৌকোতে চেপে।

তোষামোদি ও চাটুকারিতার গ্লানি এই শ্রেণির সব কর্মে। সংস্কৃতি কর্ম ব্যতিক্রম হবে কোন কারণে? এই শ্রেণি স্বাধীনতা দাবি করে উপকারী প্রভুদের ক্রুদ্ধ শত্রুতে পরিণত করবে এটা স্বাভাবিক নয়। দরকষাকষি করতে পারে বড়জোর, কিন্তু বড়রকমের ঝুঁকি নিয়ে নয়। অধিকার-চেতনার অভাবই শুধু নয়, আতঙ্কও আমাদের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডের অন্যতম প্রধান উপাদান। ভয় শুধু ওপরের প্রভুকে তো নয়। ভয় নিচের মেহনতি জনতাকেও। যদি তারা উঠে দাঁড়ায়, উঠে দাঁড়িয়ে নাস্তানাবুদ, লন্ডভন্ড করে দেয় সুযোগ-সুবিধার প্রতিষ্ঠিত আয়োজনসমূহ।

সুকান্তের রানারের মতো এই অভিসন্ত্রস্ত মধ্যবিত্ত ভয় পায় দস্যুস্বরূপ প্রভুকে এবং প্রভাতস্বরূপ কৃষক-শ্রমিককে। মানবিক-রাজনৈতিক অধিকারগুলো সে তাই নিজের জন্য চায় না। অন্যের জন্য তো চাইতেই পারে না। পরিণামে অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না জীবনে। মধ্যবিত্ত তবু কিছু অধিকার পায়, নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন তাও পায় না। কৃষকের তাই অধিকার নেই জমিতে, শ্রমিকের নেই শ্রমে, কর্মচারীর নেই কর্মে এবং জীবন নিজে মনে হয় বাঁচার কোনো অধিকার নয়, ঘাড়ে করে বইবার একটা বোঝা নয়তোবা আধিদৈবিক কোনো শক্তিকে তুষ্ট করার কোনো উপায়।

অধিকার তো কেউ কখনো দেয় না কারও হাতে তুলে। সে তো বৃষ্টি নয় যে ঝরে পড়বে আকাশ থেকে, বন্যার পানি নয় যে হৈ হৈ করে আসবে নদী থেকে। তাকে পাওয়া যায় না হঠাৎ হুঙ্কারে বা ক্রমাগত কান্নায়, তাকে পাওয়ার পথও একটাই—সার্বক্ষণিক সংগ্রাম। তাকে রক্ষা করার পথ একটাই—সার্বক্ষণিক প্রহরা। সংগ্রাম ও প্রহরায় এ যুগ কর্তব্য রাজনীতিরই যে করার কথা প্রথমত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। রাজনীতিই পরিবর্তন আনে, রাজনীতিই রক্ষা করে। কিন্তু রাজনীতি তো অসম্পূর্ণ সংস্কৃতি ছাড়া।

সাংস্কৃতিক কর্ম রাজনৈতিক কর্মকে পূর্ণতা দেয়, রাজনীতির সামনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও সঠিক পন্থা তুলে ধরে, রাজনীতির অভ্যন্তরে উন্নততর জীবনের চেতনা ও আগ্রহ সঞ্চারিত করে। রাজনীতিকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতি চলে না, সংস্কৃতিকে বাদ দিয়েও তেমনি রাজনীতি যে চলবে তার উপায় নেই, রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন নয় পরস্পর, তাই মানুষকে যদি ভালোবাসি তবে দাঁড়াতেই হবে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মানুষের মানুষ হিসেবে বাঁচার পক্ষে। যত বেশি ভালোবাসা, তত বেশি শক্ত হয়ে দাঁড়ানো, তত বেশি তীব্র থেকে তীব্রতর, তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করা মানুষের অধিকার-জ্ঞান।

জ্ঞান যে শক্তি এই মত মিথ্যা নয়, কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্য কথা এই যে, মনুষ্যত্বই শক্তি। আমরা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়ব। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম দারিদ্র্য বিরাজ করছে এই দেশে। এত অধিক সংখ্যায়, এত দরিদ্র মানুষ আর কোথাও পাওয়া যাবে না খুঁজে। কিন্তু লড়ব কোন শক্তি নিয়ে? সে শক্তি বৈদেশিক সাহায্য বা দেশি উপদেশ নয়। ধার করা পুঁজি বা খয়রাতি শুভেচ্ছা নয়। সে শক্তি জনশক্তি, জনতার শক্তি এবং জনতার কোনো শক্তিই থাকতে পারবে না যদি না অক্ষত থাকে জনতার মনুষ্যত্ব অর্থাৎ মানবিক অধিকার। অধিকারহীন মানুষ মানুষ নয়। শক্তি নয় সে, সে হচ্ছে বোঝা। যদি নতুন সমাজ চাই তবে লড়তেই হবে মনুষ্যত্বের জন্য মানুষের পক্ষে। সর্বপ্রকার অপশক্তির বিরুদ্ধে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্তের সম্পাদক, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাতক্ষীরায় ধান বোঝায় ট্রাক উলটে নিহত ২

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কালের সাক্ষী ‘অভিশপ্ত নীলকুঠি’

দুপুর ১টার মধ্যে ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

রিকশাচালকের পা ভেঙে দেওয়া সেই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার

ধানের বাম্পার ফলনের পরও হতাশ কৃষক

হোয়াটসঅ্যাপে প্রতারণা এড়াতে যা করবেন

বাঁশ-দড়ি বেয়ে মসজিদে যান ১১৫ বছর বয়সী অন্ধ মোয়াজ্জিন

আফগানিস্তানে বন্দুকধারীদের গুলিতে ৩ স্প্যানিশ পর্যটকসহ নিহত ৪

সৌদিতে বাংলাদেশি হজযাত্রীর মৃত্যু

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে স্নাতক পাসে চাকরি

১০

মেসির সেই ন্যাপকিন কত দামে বিক্রি?

১১

হাইকোর্টের আদেশ সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীর নামে থাকা স্কুলের নাম বহাল

১২

ব্র্যাক ব্যাংকে অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার পদে নিয়োগ

১৩

আজ ঢাকার যেসব এলাকায় গ্যাস কম থাকবে

১৪

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৫

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

চাঁদপুরে একদিনেই মারা গেলেন ৩ বীর মুক্তিযোদ্ধা

১৭

১৮ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৮

হামাসের সুড়ঙ্গ থেকে ৩ জিম্মির মরদেহ উদ্ধারের দাবি ইসরায়েলের

১৯

মিছিলে গিয়ে শ্রমিক লীগ নেতার মৃত্যু

২০
X