বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার পতন এবং তার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এক বছর পেরিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১,৩০০ আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপি, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বেশিরভাগ আ.লীগ নেতাকর্মী বসবাস করছেন কলকাতার নিউ টাউনে।
তাদের কয়েকজনের বর্তমান জীবনযাত্রা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট গতকাল (মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট) একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে উঠে এসেছে তাদের বর্তমান জীবনধারা, রাজনৈতিক তৎপরতা এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী আরাফাত
দ্য প্রিন্টের কাছে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। তিনি কলকাতা থেকে অনলাইনেই প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে থাকা নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তার বক্তব্য, “শেখ হাসিনার ফিরে আসা এবং ইউনূস সরকারকে হটানো ছাড়া আমার জীবনের আর কোনো লক্ষ্য নেই। আমি দিন-রাত শুধু এ নিয়েই ব্যস্ত।”
দ্য প্রিন্টকে আরাফাত জানিয়েছে, তিনি প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় ব্যয় করছেন বৈঠক, পরিকল্পনা আর অনলাইন কনফারেন্সে। পরিবারের সদস্যরা বাইরে থাকলেও তিনি জানালেন, রাজনীতির বাইরে তার আর কোনো আলাদা ব্যস্ততা নেই।
যা নিয়ে ব্যস্ত আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল
বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে এখন নিউ টাউনের একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। স্থানীয় সূত্র বলছে, তিনি প্রায়ই দিল্লি যাতায়াত করেন, সেখানে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেন। তার ছেলে সাফি মুদ্দাসসির খান জ্যোতি গত বছর ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই খান সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করছেন।
তিনি প্রায়ই সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “আমরা এখানে আরাম করতে আসিনি। বেঁচে থাকা এবং ভবিষ্যতের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যই এখানে আছি।”
নিউ টাউনের নতুন জীবনযাত্রা
নিউ টাউনের আধুনিক আবাসিক ফ্ল্যাটগুলোই এখন এই পালাতক রাজনীতিকদের প্রধান আশ্রয়। একজন সাবেক সংসদ সদস্য জানান, তাদের প্রতিদিনের রুটিন অনেকটা নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। ভোরে ফজরের নামাজের পর শরীরচর্চার জন্য জিম বা পিলাটিস ক্লাস দিয়ে শুরু হয় দিন। দুপুরে খানিক বিশ্রাম, আর বিকেল-সন্ধ্যাজুড়ে থাকে অনলাইন মিটিং ও রাজনৈতিক আলোচনা।
তিনি যোগ করেন, “কখনো কখনো নিজেই রান্না করতে হয়। তখন ভিডিও কলে ঢাকায় থাকা স্ত্রী আমাকে রেসিপি শিখিয়ে দেন। এতে নির্বাসিত জীবনে এক ধরনের মানসিক সান্ত্বনা পাই।”
প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়া প্রায় ৩০ হাজার রুপি। তবে নিউ টাউনের বিস্তৃত রাস্তা, বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থান, শপিংমল আর জিম সুবিধার কারণে তারা এই এলাকা বেছে নিয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, নির্বাসিত জীবনের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ ও সুবিধাজনক জায়গা আর পাওয়া কঠিন।
গোপন কার্যালয়ের গুঞ্জন
বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছে যে, কলকাতায় আওয়ামী লীগের একটি গোপন কার্যালয় রয়েছে, যেখান থেকে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। তবে এ গুঞ্জনকে খারিজ করে এক সাবেক সংসদ সদস্য বলেছেন, “আমরা কেবল বৈঠকের জন্য একটি জায়গা ভাড়া নিয়েছি। এখানে প্রায় ১,৩০০ নেতা একসঙ্গে বৈঠক করেন। এটিকে অফিস বলা বাড়াবাড়ি।”
কানাডায় লেখালেখিতে কূটনীতিক
এদিকে, সাবেক কূটনীতিক হারুন আল রশিদ ভারতে নয়, বরং কানাডার অটোয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। নির্বাসিত জীবনে তিনি লেখালেখিকেই বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি The Mapmaker’s Prayers শিরোনামে একটি উপন্যাস লিখছেন। এতে তিনি ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
তরুণ এমপির চুল প্রতিস্থাপন
রাজনীতির ব্যস্ত জীবনে ঢাকায় থেকে কখনো সময় পাননি নিজের দিকে নজর দেওয়ার। কিন্তু কলকাতায় এসে অবশেষে দিল্লি গিয়েই এক তরুণ সাবেক এমপি চুল প্রতিস্থাপন করিয়েছেন। তিনি মজা করে বলেন, “এমন কঠিন সময়ে মাথাভর্তি নতুন চুল অন্তত আমাকে মানসিকভাবে কিছুটা আনন্দ দিয়েছে। জীবনের প্রতি আবারও আশাবাদী হয়েছি।”
সবমিলিয়ে কলকাতার নিউ টাউনে পালাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের জীবন এখন এক ভিন্ন ছন্দে চলছে। কেউ দিন কাটাচ্ছেন রাজনৈতিক বৈঠকে, কেউ লেখালেখিতে, কেউবা পরিবার নিয়ে নতুন করে জীবন সাজানোর চেষ্টায়। কেউ জিম ও পিলাটিসে শরীরচর্চা করছেন, কেউ ব্যক্তিগত রূপে পরিবর্তন আনছেন। তবে সব ভিন্নতার মাঝেও তারা তাকিয়ে আছেন বাংলাদেশের ক্ষমতার দিকে।
মন্তব্য করুন