শংকর মৈত্র
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩২ এএম
আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৩৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন কমিশন কি ধন্যবাদ পেতে পারে না

নির্বাচন কমিশন কি ধন্যবাদ পেতে পারে না

অনেক আলোচনা-সমালোচনা আর অনেক অনিশ্চয়তার পর শেষ পর্যন্ত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা। ভোটকেন্দ্রে যারা ভোট দিতে গিয়েছেন, তারা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছেন। একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দেননি। দিনের ভোট রাতেও হয়নি। নির্বাচন কমিশনের হিসাবমতে, ৪১ শতাংশের বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন। ভোটে আওয়ামী লীগ ২২২, জাতীয় পার্টি ১১টি, জাসদ একটি, কল্যাণ পার্টি একটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি এবং স্বতন্ত্র ৬২টি আসনে বিজয়ী হয়েছে।

নির্বাচনে বিজয়ের পর ১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। এর পরদিনই নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। তিনি টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন আর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার অর্থাৎ পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন, যা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যেও বিরল ঘটনা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি। কিন্তু গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় এটাকে আমলে নেওয়া যায় না। কারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার কিন্তু বাধ্যবাধকতা নয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের বিধিবিধান মেনে যে কোনো দলই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, নাও নিতে পারে। আর এই বিধিবিধান হলো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হবে। যে কোনো নাগরিক রাজনৈতিক দল ছাড়াও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তাকেও কিছু বিধিবিধান মানতে হয়। তার এলাকার নির্ধারিতসংখ্যক ভোটারের স্বাক্ষরসংবলিত সমর্থনে দালিলিক প্রমাণ দাখিল করতে হয়। দালিলিক প্রমাণে গরমিল থাকায় এবার অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে।

এবারের নির্বাচনে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে এটা বলাই যায়, নির্বাচন কমিশন কঠোর অবস্থানে থেকে তার দায়িত্ব পালন করেছে। শিডিউল ঘোষণার পর পরই প্রার্থীদের আচরণবিধি প্রতিপালনের জন্য ২৮ নভেম্বর থেকে সারা দেশে ৮০২ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে। এই ম্যাজিস্ট্রেটরা কঠোর অবস্থানে ছিলেন। কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থা থেকে বাদ যাননি ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান থেকে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে দুজন প্রার্থীকে আর্থিক জরিমানা পর্যন্ত করা হয়েছে। দুজনই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী। তাদের একজন কুমিল্লার বাহাউদ্দিন বাহার, আরেকজন বরগুনার ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রার্থীকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে নানাভাবে সতর্ক করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভয়ে প্রার্থীরাও ছিলেন তটস্থ। মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে পোস্টার-ব্যানার লাগানো পর্যন্ত তাদের সতর্ক থাকতে হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করে দিয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হুমকি দেওয়ায় ভোট গ্রহণের দিন নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়, যা এক নজিরবিহীন ঘটনা। নির্বাচন কমিশনের এমন কঠোর পদক্ষেপে স্বস্তি ফিরে আসে ভোটারদের মধ্যে। শক্তিশালী প্রার্থীর দুর্বল প্রতিপক্ষও অনেকটা স্বস্তির মধ্যে ছিলেন। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে সহিংসতা যে হয়নি তাও বলা যাবে না।

শিডিউল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে এটা বলাই যায়, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্ব নির্বাচন কমিশন একটা সফল নির্বাচন উপহার দিয়েছে। তারা আইনের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে না পারা নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন, এটার দায়ভার নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায় না। কারণ ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ভোটার হাজির করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। ভোট দেওয়া নাগরিকের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। ভোট দিতে না যাওয়াটাও তার ব্যক্তিগত অধিকার। নির্বাচন কমিশন কাউকে বাধ্য করতে পারে না। কমিশনের দায়িত্ব ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা, ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা না। এ ক্ষেত্রে কমিশন যথার্থ ভূমিকাই পালন করেছে। প্রতি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীও মোতায়েন ছিল। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, এজন্য ৫ থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দিনের জন্য ৬৫৩ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়। যাদের দায়িত্ব ছিল নির্বাচনী অপরাধ আমলে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচার করা। ফলে কেন্দ্রের নিরাপত্তা ছিল শতভাগের শতভাগই। আর ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সেনা মোতায়েন করা হয়। এর আগে মোতায়েন করা হয় আধাসামরিক বাহিনী বিজিবি। ফলে সারা দেশ ছিল কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে এবার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গাফিলতির কোনো অভিযোগ দাঁড় করানো যাবে না।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ আসে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়টি। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়। নির্বাচন কমিশনের কাজ এটা নয়, তাদের কোনো দায়ও নেই এ বিষয়ে। কোন দল নির্বাচনে এলো আর কোন দল এলো না, সেটা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। নির্বাচন কমিশন তার বিধিবিধান মেনে নির্বাচন সম্পন্ন করার দায়িত্ব পালন করে। কাজেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তপশিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত এবার নির্বাচন কমিশন চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। মোটা দাগে আউয়াল কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা যাবে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেক কিছুই হয়তো করা সম্ভব হয় না। আইন না মানার প্রবণতা এখানে সবচেয়ে বেশি। সেই অবস্থায় থেকে যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে একটা নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছে, এজন্য নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়।

ভোটার তুলনামূলক কম উপস্থিতি হলেও একেবারে কম ছিল তা কিন্তু বলা যাবে না। ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়, সারা দেশে গড়ে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এটা গড় হিসাব। অনেক আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে এবং ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। ৮৭ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে গোপালগঞ্জ-৩ আসনে; যেখানে প্রার্থী ছিলেন শেখ হাসিনা। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এবার ৮০টি আসনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে। এই নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়ে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে বিএনপির অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে। এতে ভোট পড়ে মাত্র ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

এ যাবতকালের ভোটের হার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একমাত্র বিএনপির অধীনে খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে, মাত্র ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া সব নির্বাচনেই ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যদি ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়ে, সেটাকে কম বলার কোনো কারণ নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টিভিতে আজকের যত খেলা

‘বিদেশি নম্বর’ থেকে ফোন করে ওসিকে হত্যার হুমকি

ইসরায়েলকে বোমাবর্ষণ থামাতে ট্রাম্পের আহ্বান

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড়বৃষ্টি

৪ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

শনিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

গরুর মাংসে হাড়-চর্বি বেশি দেওয়ায় সংঘর্ষ

‘বিএনপি ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না’

এক ইলিশ ১০ হাজার টাকা

ভাতের হোটেলের পাওনা চাওয়ায় গুলি

১০

ব্যক্তি স্বার্থে দলকে ব্যবহার করা যাবে না : সেলিমুজ্জামান

১১

‘জনগণের অধিকার ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বিএনপি’

১২

নিউইয়র্কের প্রবাসীদের এনআইডি কার্যক্রমের উদ্বোধন

১৩

কুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

১৪

ফের জামায়াতের সমালোচনা করলেন হেফাজত আমির

১৫

জবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেতা হাসিবুলের প্রথম জানাজা সম্পন্ন

১৬

গণতন্ত্রে উত্তরণে বিশ্বের সমর্থন পাওয়া গেছে : মির্জা ফখরুল

১৭

আমরা পা ছেড়ে মাথার রগে ফোকাস করছি, মজার ছলে সর্ব মিত্র

১৮

নাটকীয় ম্যাচ জিতে টাইগারদের সিরিজ জয়

১৯

জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যুতে হাসপাতালে ভিপি সাদিক কায়েম

২০
X