বাহাউদ্দিন গোলাপ
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৫:১৩ পিএম
আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৬:২২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আলো-অন্ধকারের দার্শনিক : জহির রায়হানের জন্মবার্ষিকীতে গভীর অভিবাদন

সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান (বামে) এবং লেখক বাহাউদ্দিন গোলাপ। ছবি : সংগৃহীত
সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান (বামে) এবং লেখক বাহাউদ্দিন গোলাপ। ছবি : সংগৃহীত

কালের মহাসাগরে ভাসমান মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিছু নাম আলোকস্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, যারা শুধু নিজের সময়কেই আলোকিত করেন না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথও প্রজ্বলিত রাখেন। এমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান।

জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার মিঠাখালি। তখন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটতে চলেছে, কিন্তু বাংলার আকাশে জমে উঠছে বিভাজনের কালো মেঘ। সমাজে দারিদ্র্য, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা—সেই অন্ধকার যুগেই জন্ম নিলেন তিনি, যিনি পরবর্তীতে আলো হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।

শৈশব কেটেছে তার গ্রামীণ বাংলার রূপময় প্রকৃতির কোলে, যেখানে নদীর কলতান, মাটির গন্ধ এবং মানুষের সহজ-সরল জীবনধারা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল চিরকালের জন্য। পড়াশোনা করেছেন মিত্র ইনস্টিটিউশন, আলিয়া মাদ্রাসা, কলকাতা মহানগর কলেজে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সময়ের পরিক্রমায় কলকাতা এবং পরে ঢাকার শিক্ষাজীবন তাকে আধুনিকতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, তৈরি করে এক অনন্য শিল্পীসত্তা যেখানে গ্রাম্য জীবনবোধ এবং নাগরিক সংস্কৃতি একাকার হয়ে গেছে। তার লেখনীতে এই দ্বৈত সত্তার পরিচয় মেলে বারবার - একদিকে যেমন আছে বাংলার মাটির গভীর টান, অন্যদিকে তেমনি আছে শহুরে জীবনের জটিলতা ও নাগরিক সংকট।

তার সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ছোটগল্প দিয়ে। প্রথম গল্প ‘ছোট্ট একটি ঘটনা’ (১৯৫১) প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তিনি পাঠকের নজর কাড়েন। এরই মধ্যে বাংলা সাহিত্য জগতে শুরু হয়েছে আধুনিকতাবাদী ও সমাজমনস্ক লেখালেখির ঢেউ। শওকত ওসমান, আবুল ফজল কিংবা শহীদুল্লাহ কায়সারদের মতো লেখকের পাশে দাঁড়িয়ে জহির রায়হান গড়ে তুললেন নিজস্ব ভাষা—যেখানে বাস্তবতা ও রোমান্টিকতা একীভূত হয়ে তৈরি করে নতুন এক ধারা। সুরঙ্গ (১৯৬০) গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্প যেন একেকটি জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিসরে বড় সত্যের আবিষ্কার। শহুরে জীবনের নিঃসঙ্গতা, মধ্যবিত্তের সংকট, নারীর আত্মানুসন্ধান - এসব বিষয় তিনি এমন নিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন যে প্রতিটি গল্প পাঠককে নাড়া দেয় গভীরভাবে। তার গল্পের ভাষা কখনো কাব্যিক, কখনো বাস্তবনিষ্ঠ, কিন্তু সর্বদাই স্পর্শকাতর এবং শিল্পিত। প্রতিটি বাক্য যেন একেকটি তুলির আঁচড়, মিলে মিশে তৈরি করে এক পরিপূর্ণ চিত্রকল্প।

জহির রায়হান উপন্যাসের বিশালতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এক অনন্য শিল্পীসত্তা নিয়ে। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক, যেখানে গ্রামীণ জীবনের রূপান্তর, নারীর অন্তর্লীন সংগ্রাম এবং সমাজের পরিবর্তনশীল গতিধারা এক অপূর্ব শিল্পসুষমায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র যেন বাংলার মাটির গভীর থেকে উঠে আসা জীবন্ত প্রতিমূর্তি - তাদের হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা, জয়-পরাজয় আমাদের নিজেদেরই জীবনের কথা বলে। তাঁর ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের উত্তাল সময়কে ধরেছেন এমন এক শিল্পসৌকর্যে, যেখানে ব্যক্তিগত টানাপোড়েন এবং জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা একাকার হয়ে গিয়েছে। ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ নারীর জীবনের ভেতরকার অন্তর্লীন ব্যথা ও আত্মত্যাগকে কাব্যিক ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছে। আর ‘বরফ গলা নদী’ উপন্যাসে প্রেমের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে - যেখানে ভালোবাসা শুধু আবেগ নয়, বরং এক গভীর দার্শনিক অনুসন্ধান। সেই সময়ে বাংলা উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও সেলিনা হোসেনরা যেমন সামাজিক ইতিহাসের জটিলতায় প্রবেশ করছিলেন, তেমনি জহির রায়হানও ইতিহাসকে মানুষের অন্তর্গত রূপের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন অসাধারণ মুন্সিয়ানায়। তার প্রতিটি লেখা যেনো সময়ের সঙ্গে গভীর আলাপচারিতা, যেখানে ব্যক্তিগত প্রেম যেমন আছে, তেমনি জাতির ইতিহাসেরও প্রতিফলন ঘটে।

তার শিল্পীসত্তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন সেই বিরল প্রতিভা যিনি শব্দ এবং ছবির মেলবন্ধনে নতুন এক শিল্পভাষা সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথমে চিত্রনাট্যকার, পরে পরিচালক হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ ছবির মাধ্যমে শুরু হয় তার পরিচালনা জীবন। এর পরের বছরেই ‘কাচের দেয়াল’। এরপর তিনি নির্মাণ করেন সংসার (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫), আনোয়ারা (১৯৬৭), বেহুলা (১৯৬৬)—যেখানে বাঙালির লোককাহিনি ও সংস্কৃতিকে আধুনিক চলচ্চিত্রভাষায় রূপ দেন। তার চলচ্চিত্রচর্চার সময়কাল ছিল বাংলা সিনেমার এক সন্ধিক্ষণ। পাকিস্তানি সেন্সরশিপের কষাঘাতে চলচ্চিত্রে বাংলা জাতিসত্তা চর্চা ছিল কঠিন; কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুতে জহির রায়হান চলচ্চিত্রকে সরাসরি জাতীয় সংগ্রামের হাতিয়ার বানালেন। জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) চলচ্চিত্রটি তার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি, যেখানে পারিবারিক স্বৈরাচারের রূপক দিয়ে তিনি পাকিস্তানি সামরিক শাসনের চেহারা প্রকাশ করেন। দর্শকরা বুঝেছিল, এ কেবল একটি গল্প নয়, এ মুক্তির ডাক।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্র, যা বাংলাদেশের গণহত্যার চিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল।

তার শিল্পচর্চার মূলে ছিল এক গভীর দার্শনিক ভিত্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্প শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি সামাজিক পরিবর্তনেরও হাতিয়ার। তার সৃষ্টিকর্মে বারবার ফিরে এসেছে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন। তিনি শিল্পের মাধ্যমে সমাজকে প্রশ্ন করতে চেয়েছেন, মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন, পরিবর্তনের ডাক দিতে চেয়েছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলেরই উত্তরসূরি, যারা শিল্পকে মানুষের মুক্তির পথ হিসেবে দেখতেন।

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক জাগরণে জহির রায়হান হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন পুরো জাতি নতুন পরিচয় খুঁজছিল, তখন তিনি তার সৃজনশীলতা দিয়ে সেই জাতীয় চেতনা নির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে সেই সম্ভাবনা অপূর্ণ রয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই জহির রায়হান নিখোঁজ হন। তার এই অকালপ্রয়াণ শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগত হয়তো আজ আরও সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু তার রেখে যাওয়া সাহিত্য ও চলচ্চিত্র আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আজ যখন আমরা তার ‘হাজার বছর ধরে’ পড়ি বা ‘জীবন থেকে নেয়া’ দেখি, তখন আমরা শুধু শিল্পের সৌন্দর্যই উপভোগ করি না, আমাদের নিজেদের ইতিহাস ও সংগ্রামকেও নতুনভাবে আবিষ্কার করি।

তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পী শুধু সমাজের দর্পণ নন বরং তিনি সমাজের বিবেকও। তার জীবন ও কর্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিল্পের শক্তি কতটা গভীর হতে পারে- এটি শুধু হৃদয়কে স্পর্শ করে না, বিবেককেও জাগ্রত করে। আজ যখন আমরা তার সৃষ্টিকর্মের আলোকে নিজেদের জীবনকে বিচার করি, তখন আমরা এক নতুন দিগন্তের সন্ধান পাই। কারণ জহির রায়হানের মতো মহৎ শিল্পীরা কখনো মারা যান না। তারা বেঁচে থাকেন অনন্তকাল, তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে- মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে।

লেখক: বাহাউদ্দিন গোলাপ, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পরীক্ষা শুরুর আগে হলেই কলেজছাত্রীর মৃত্যু

সীমান্তে ১১ বাংলাদেশিকে আটকের পরে ফেরত দিল বিএসএফ

বিস্ফোরণ মামলায় ফখরুলসহ ৬৫ জনকে অব্যাহতি

রাঙামাটিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে দুদকের অভিযান

আর্জেন্টিনায় ম্যাচ চলাকালে সমর্থকদের তুমুল মারামারি

আশুলিয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জুয়েল গ্রেপ্তার

৬০০ কোটি আয় ছাড়াল রজনীকান্তের ‘কুলি’

শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে ট্রাইব্যুনালে সাইদীর মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি

গাজীপুরে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়ে নির্দেশনা দিলেন হাইকোর্ট

১০

ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের ছবি যুক্তের দাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের

১১

ভারতের জন্য আকাশসীমা বন্ধের মেয়াদ আরও বাড়াল পাকিস্তান

১২

র‌্যাঙ্কিংয়ে উধাও রোহিত-কোহলির নাম, কারণ জানাল আইসিসি

১৩

রাজসাক্ষী হতে চান পুলিশ সদস্য শেখ আফজালুল

১৪

ভাঙন ভাঙন খেলায় দিশেহারা নদীপাড়ের মানুষ

১৫

চালককে ওয়াশরুমে রেখে প্রাইভেটকার নিয়ে ছুটছিলেন তিন বন্ধু

১৬

নথি গায়েব করে ১৪৬ কোটি টাকার কর ফাঁকি / কর কমিশনার মো. মুস্তাকসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক

১৭

‎আশাশুনি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের স্থায়ী ভবন নির্মাণে জরুরি আলোচনাসভা

১৮

দেবের প্রশংসায় ইধিকা

১৯

গ্যাসের ব্যথা ভেবে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নিয়ে ঘুরছেন না তো?

২০
X