রাজধানীসহ সারা দেশের বড় শহরগুলোতে পথশিশুদের ড্যান্ডি নেশায় আসক্তির বিষয়টি নতুন কোনো খবর নয়। তবে এ আসক্তদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একটি সভ্য সমাজব্যবস্থার মধ্যে নাবালক শিশুদের এ চিত্র যে অত্যন্ত দুঃখজনক—এ কথা বলাইবাহুল্য। প্রতিটি শিশু পৃথিবীতে জন্ম নেয় অপার সম্ভাবনা নিয়ে। সেই সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সভ্য দুনিয়ার একটি সমাজে একজন মানুষ অন্তত তার মৌলিক অধিকার—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চয়তা পাবে, এটাই স্বাভাবিক। অথচ নাবালক শিশুদের বিভিন্ন কারণে সমাজের মূলধারা থেকে ছিন্ন হয়ে পথে-ঘাটে-দিনে-রাতে সব ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে জীবনের সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে, তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে; তাদের একটি সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আসলে কার? নিশ্চয়ই এ সমাজ বা রাষ্ট্রের? কালবেলায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আসক্ত পথশিশুদের অধিকাংশই খাবারের অভাবে ড্যান্ডি সেবন করে। পথশিশুদের একজন যখন বলে, ‘একমুঠো ভাতের জন্য অনেক কষ্ট করছি। অনেক মানুষের মাইর খাইছি ভাই আর আমি। আমার বন্ধু বলছে, এটা খাইলে ক্ষুধা লাগে না। ওর কাছ থিক্যা খাওন শিখছি। ভাঙাড়ি টোকাইয়া বিক্রি কইরা হার্ডওয়্যারের দোকান থিক্যা ৮০ টাকায় কিনি। এইট্যা খাইতে খাইতে যেদিকে মন চায় চলতে থাকি’—তখন এ সমাজের নীতিনির্ধারণকারীরা কি তাদের দায় এড়াতে পারেন? সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এ শিশুদের নেই থাকা-খাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা বা জীবনের শৃঙ্খলা। নেই জীবন নিয়ে স্বপ্ন কিংবা আকাঙ্ক্ষা। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন থেকেও যত্নহীন, আবার কারও কারও পরিবার-পরিজন বলতে আদৌ কেউ আছে কি না, তারা নিজেরাও জানে না। তাদের রোগবালাই থেকেও নেই, চিকিৎসা নেই। আছে শুধু একটি চাহিদা গাম বা জুতার কষ বা ড্যান্ডি সেবন করা। সে কষই বশ করে ফেলেছে অগণিত শিশুর জীবন। ড্যান্ডির নেশায় জড়িয়ে পড়া শিশুদের জীবনের গল্পটা এমনই বেদনাময়। রাজধানীর মোটামুটি সব এলাকায় টোকাইয়ের কাজ করা অধিকাংশ পথশিশুর হাতে দেখা মিলবে ড্যান্ডির। এর মধ্যে সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, কমলাপুর, মুগদা, মতিঝিল, মহাখালী, কারওয়ান বাজার, গাবতলী, আমিনবাজার, টঙ্গী এলাকায় এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্যান্ডি সেবনে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ক্ষতি হয়। মস্তিষ্কে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এ ছাড়া শিশুরা ক্ষুধার জ্বালা ভুলতে ও ভালো করে ঘুমানোর আশায় ড্যান্ডি খায়। ঘুমিয়ে গেলে আর ক্ষুধার কথা মনে থাকে না। পথশিশুদের প্রায় ৮৫ শতাংশই কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত। অবহেলা অনাদর আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা এসব শিশুকে বিশেষ করে ঢাকা শহরে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে থাকে অপরাধী চক্র। আমরা মনে করি, দেশের প্রায় দশ লক্ষাধিক পথশিশু সামাজিকভাবে সব ধরনের বঞ্চনার শিকার। শুধু ড্যান্ডি বা মাদকাসক্ত শিশুরাই নয়, চরম দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগ, নিরক্ষরতা ও সহিংসতাসহ নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে বেড়ে ওঠা সব পথশিশুকেই যেভাবে হোক, সমাজের মূলধারায় ফেরানোর বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী চিন্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিশুদের পুনর্বাসন, লেখাপড়া শেখানো, ভোকেশনাল ট্রেনিংসহ মূল স্রোতে যুক্ত করার নানা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
মন্তব্য করুন