রাজনীতি-অর্থনীতি-কূটনীতি মিলিয়ে সরকারের ১১ ওয়াদা পূরণের কথা বেশ আলোচিত। ওয়াদা মানে চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বিভেদে নতুন যাত্রা শুরু হলেও এরই মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপিসহ দলটির সমমনারা কী করবে বা করতে পারে, তা সরকারের জানা। কূটনৈতিক তথা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও একে একে আয়ত্তমুখী। মাঠকাঁপানো বিদেশি কূটনীতিক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস কথা-কাজে সীমিত হয়ে পড়েছেন। সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন কাজ করবে বলে বার্তাও দিয়েছেন তিনি। বাকি ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউ। সেখানেও এখন বৃহস্পতির লক্ষণ। টানা চতুর্থবার ফের নির্বাচিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বৃহস্পতিবার সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এ অভিনন্দন জানান। নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশ-ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক ও অংশীদারত্বকে অনন্য উচ্চতায় নেওয়ার কথাও জানান হোয়াইটলি। জলবায়ু, সুশাসন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বৈশ্বিক পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি ইইউর সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান। বৃহস্পতির বার্তা দিয়েছে বিশ্বব্যাংকও। বৃহস্পতি দিনটির সকালে, সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক। তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর ফাঁকে দিয়েছেন বাংলাদেশের আর্থিক
খাতে আরও সংস্কারের তাগিদ, যা তাদের বরাবরের নিয়মিত কাজ।
রাজনীতি-কূটনীতির এ আয়ত্তমুখিতার বাইরে বাকি থাকছে শুধু অর্থনীতি। আর অর্থনীতির ব্যাপক অংশ নিত্যপণ্যের বাজার। মাঠ পরিস্থিতিতে সরকারের সামনে মোটাদাগে চ্যালেঞ্জ একটাই, বাজার সামলানো। সোজা কথায় খাদ্যপণ্যের দাম কমানো। ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ শিরোনামে এবারের নির্বাচনী ইশতেহার আওয়ামী লীগের। শিরোনামে কর্মসংস্থান শব্দটি আনা হলেও মূল ওয়াদা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। যে কোনো অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়টি মূলত নির্ভর করে সরকারপ্রধান ও সরকারের কৌশলের ওপর। এর আগে চারবার সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে শেখ হাসিনার। তার আন্তরিকতাও প্রশ্নমুক্ত। দ্রব্যমূল্যের ওয়াদা বাস্তবায়নে বেশি সম্পৃক্ত অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, কৃষিসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি বন্ধ করা, বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর একনিষ্ঠ সহকর্মী হবেন বলে ধারণার সঙ্গে বিশ্বাসও অনেকের। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি বন্ধ করা, বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা না করার বিকল্প নেই সরকারের সঙ্গে।
লক্ষণীয় বিষয়, নতুন সরকারের শপথের পরদিনই চালসহ কিছু নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ চড়েছে। এ নিয়ে দোকানদার, পাইকার, আড়তদারদের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ভিন্ন কিছুর বার্তা দেয়। চাল-তেল বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে বড় রকমের ঐতিহাসিক আইটেম। এসবের দাম চড়াতে একটি দিনও পার হতে না দেওয়ার মধ্যে একটি উৎকট গন্ধ অনুমেয়। এটি সরকারকে পেয়ে বসা বা কাবু করার একটি আলামত। এমনিতেই যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে নতুন করে পণ্যমূল্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা ঘুরছে। তার ওপর বাজার সিন্ডিকেট নতুন কোনো উদ্যম পেয়ে থাকলে তা সরকারের ওয়াদা বরবাদের দাওয়াই হয়ে উঠতে পারে। তা শক্ত হাতে দমন করতেই হবে। সেই সক্ষমতা সরকারের অবশ্যই আছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আয়ত্ত করার চেয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই কঠিন নয়। বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ন্ত্রণ বা দমনের চেয়ে কঠিন নয় বাজার নিয়ন্ত্রণও। চাল-পেঁয়াজ-আলুতে তেলতেলে হওয়া সিন্ডিকেট সাহেবরা বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে শক্তিমান নয়।
দ্রব্যের মধ্যে চাল বড় স্পর্শকাতর। চাল থেকেই হয় ভাত। আর ভাতের অধিকারই একপর্যায়ে ভোটের অধিকারে রূপ নিয়ে অনিবার্য করেছে ঐতিহাসিক একাত্তর তথা মুক্তিযুদ্ধকে। বাংলায় সুদিনের উদাহরণ খুঁজতে এখনো শায়েস্তা খাঁর আমলকে সামনে নিয়ে আসা হয়। তখন এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত বলে প্রতিষ্ঠিত। আর পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসন বোঝাতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিমণ চাল ৫০ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ১৮ টাকায় বিক্রি হওয়ার তথ্য হাজির করা হতো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। পাকিস্তান আমলের দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেড়ে এখন প্রায় ৭ শতাংশে উন্নীত করেছে। নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ থেকে আমরা মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু চাল নিয়ে ‘রাজনৈতিক চাল’ বন্ধ হয়েছে বলে মনে হয় না। স্বাধীনতার পর ৮০ ভাগ মানুষের তিনবেলার খাবার ছিল ভাত। এখন তা কমে ৬৫ শতাংশ হয়েছে। গত ৪০ বছরে ধানের উৎপাদন ১ কোটি টন থেকে বেড়ে ৩ কোটি ৪০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। কিন্তু চালের রাজনীতি ঠিকই চলছে। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের কেজি ৪০ টাকা ছুঁয়েছিল বলে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা ও ২০১৩ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। সেই ওয়াদা রাখতে গিয়ে সরকার সার-বীজ-কীটনাশকের ব্যাপারে যথাসম্ভব সতর্ক থেকেছে। এবার নিত্যপণ্য নিয়ে সময়োপযোগী ওয়াদার সঙ্গে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক অনেক চ্যালেঞ্জও যোগ হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা নেওয়ার পরদিনই চালসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনা সরকারের জন্য একটি খারাপ বার্তা।
নানা তথ্য, জরিপ ও হিসাবের আলোকে সরকার দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করে। চাল উৎপাদনের মোট হিসাব ও দুর্যোগে ধানের ক্ষতির প্রকৃত হিসাব আড়াল করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অন্তত বাঙালির প্রধান খাদ্য চালের কোনো কমতি নেই বাজারে। সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও মাঝেমধ্যে চাল আমদানির খবর। কদিন পরপরই চাল নিয়ে চালবাজিও চলে। এবার সেটা ঘটল টানা চার মেয়াদের সরকারের নতুন করে শপথ নেওয়ার পরদিনই। বিষয়টি মোটেই স্বাভাবিক নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ’-এর এই দেশে ১৭৭০ ও ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আন্তর্জাতিক খাদ্য রাজনীতির শিকার হয়ে ১৯৭৪ সালেও আরেকবার বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। সেই অতীত মনে রাখার দরকার আছে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট কিছুটা পরিবর্তনের দিকে। তবু পণ্যের দাম কেন সহনীয় পর্যায়ে নেই? এ প্রশ্নে বাজার বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র জবাব। সামনে রোজা। সময়টা স্পর্শকাতর। তেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও খেজুরের দাম যেন নতুন করে না বাড়ে সেদিকে নজরদারির বার্তা দিয়েছে সরকার। ১ জুলাই থেকে বাজারে সিন্ডিকেট নামে কিছু থাকবে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটো। এ-ও জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামার পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যের দাম ধরার পক্ষে নন তিনি। এই ধরাধরি-দরাদরিতে আগেও সুফল আসেনি। তাহলে এবার নেওয়া হবে কোন পদক্ষেপ—প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। জুলাইর পর সিন্ডিকেটরা কই যাবে, এর আগে তাদের শায়েস্তা করা সম্ভব নয় কেন, তাও বার্নিং কোশ্চেন। জুন পর্যন্ত পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মাস কি তাদের আখেরি ছাড় দেওয়া হচ্ছে? সিন্ডিকেট কি জুলাইয়ের পর অন্য নামে আসবে?—এমনতর আরও কিছু প্রশ্ন চক্কর খাচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদারের বক্তব্যে এসব প্রশ্নের কিছু জবাব আছে। অনৈতিকভাবে চালের দাম চড়ানোতে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরাসরি সম্পৃক্ত কৃষি, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়। কোনো মন্ত্রণালয়ের অস্বীকারের জো নেই, খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দামে নিয়ন্ত্রণহীনতার এক রেকর্ড পার করছে বাংলাদেশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতেও রেকর্ড। আলু-ডিম-পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি সিন্ডিকেট সম্প্রদায়ের কিছু চুনোপুঁটিকে ধরা হলেও হোতারা থেকেছে অধরা। যেই মন্ত্রী বলেছিলেন, সিন্ডিকেটকে ধরা যাবে না, ধরলে সরকার ঝামেলায় পড়বে—সেই মন্ত্রী এবারের মন্ত্রিসভায় নেই। আবার যেই প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, কয়েক মন্ত্রীও আছেন সিন্ডিকেটের মধ্যে—সেই প্রতিমন্ত্রীরও জায়গা হয়নি নতুন মন্ত্রিসভায়। এটি অবশ্যই একটি সংকেত। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে সিন্ডিকেট নামে পরিচিতরা দেশের বাইরের কেউ নয়। অজানা-অচেনা-অদেখাও নয়। চাল, পেঁয়াজ, ডিম, তেল, আলু থেকে লতি-শুঁটকি পর্যন্ত তাদের হাত থাকলেও ওই হাত সরকারের হাতের চেয়ে বড় নয়। পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির আগের বছর চুয়াত্তরে নিত্যপণ্যের বাজার ও অর্থনীতিতে অন্তর্ঘাত তৎপরতার জন্য আজও জবাব দিতে হয় আওয়ামী লীগকে। তখনো অভিযান চালিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা হয়েছিল। দুর্ভিক্ষ তৈরির হোতারা চিহ্নিত হলেও তাদের শায়েস্তা করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু ক্ষোভে-দুঃখে তাদের চাটার দল বলে গালমন্দ করেছিলেন। তার ওই সাহসী, সরল উচ্চারণ পরবর্তী রাজনীতিতে নোংরাভাবে সামনে আনা হয়েছে তাকে ও তার সরকারকে কলঙ্কিত করতে। শুধু গালমন্দ বা সাহসী উচ্চারণ নয়, ওই চক্রটিকে শায়েস্তা করতে তিনি সেনা অভিযানও চালিয়ে ছিলেন। ঘটনার অনিবার্যতায় অল্প সময়ের মধ্যে সেই অভিযানটি থামিয়ে দিতে হয়। এখন রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব পরিস্থিতির কথা বেশি শোনালে তারা একে সুযোগ হিসেবে নেবে।
লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন