সাংবাদিক রাশীদ উন নবী—আমাদের বাবু ভাই নেই তিন বছর। করোনার দুঃসময়ে ক্যান্সারের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। আমি অভিভাবক হারিয়েছি; সেটি নির্মম সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য, দেশের সংবাদপত্রে তার সৃষ্টিশীল চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া থেকে সবাই বঞ্চিত হয়েছি এবং হচ্ছি। গম্ভীর মানুষটির সঙ্গে অনেকের কতশত স্মৃতি। তাই তো বার্তা-মেকআপ রুমের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসেন তিনি। তার শূন্যতা বোধ করেন সহকর্মীদের অনেকেই। কদিন আগেও দৈনিক সকালের খবরের এক সহকর্মী আক্ষেপ করেই বললেন, ‘ইস! বাবু ভাই যদি থাকতেন। তাহলে ভরসার একটা জায়গা থাকত।’ আসলেই তো। ছিলেন ছায়ার মতো। দলীয় মতভেদ ভুলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন বার্তাকক্ষে। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ডামি, মেকআপ সামলেছেন। আবার জুনিয়রদের সবকিছু শিখিয়েছেনও। বাবু ভাই পত্রিকার মেকআপ নিয়েও অনেক ভাবতেন; ভাঙাগড়া করতেন নিয়মিতই। এ কারণে মফস্বলের সঙ্গে নগর সংস্করণের পত্রিকার বিস্তর পার্থক্য থাকত। ফটো কম্পোজিশনের ক্ষেত্রেও তার কাজ ছিল অতুলনীয়। সাধারণ ছবিকেও তিনি অসাধারণ করে তুলতেন। ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক। তার মধ্যে কুৎসা রটানো, রেষারেষির ব্যাপারটা ছিল না। এ কারণে আমার দেশের পরিবেশ ছিল সত্যিই ব্যতিক্রম। তিনি সেখানে ভিন্ন মতের সাংবাদিকদের এক সুতোয় বাঁধতে পেরেছিলেন। ছাপা পত্রিকায়ও তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। সকালের খবরের শুরুর সময় বাবু ভাই পত্রিকাটিতে বৈচিত্র্যও এনেছিলেন। আগে দেশের সব পত্রিকায় প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা থেকে জাম্প দেওয়া ছিল কমন রীতি। কিন্তু তিনি সেই রীতিও ভেঙেছিলেন। পত্রিকাটির একাধিক রিপোর্ট জাম্পহীন করা হতো। এখন বেশকটি পত্রিকা সেই চর্চা শুরু করেছে। বাবু ভাইয়ের আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল শ্রদ্ধাবোধ। সিনিয়রদের সঙ্গে যেভাবে কাজ করতেন, তা অতুলনীয়। আমার দেশের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদ। সেখানে সামাদ ভাইকে সর্বোচ্চ সম্মান করতে দেখেছি। বাবু ভাই পত্রিকার অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তি হয়েও সামাদ ভাই তার ডেস্কের সামনে এলে দাঁড়িয়ে যেতেন। সামাদ ভাই না বসা পর্যন্ত তিনিও দাঁড়িয়ে থাকতেন। একই রকম দেখেছি সমকালের প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ভাইকে সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও। আর কালবেলার প্রধান সম্পাদক আবেদ খান ভাইকে তিনি আপন ভাই হিসেবে মান্য করতেন। মাঝেমধ্যে বলতেও শুনেছি, ‘আবেদ খান তো আমার বড় ভাই। দেখো না, আমাদের চেহারায় কত মিল!’
বাবু ভাইয়ের আরেকটি গুণের কথা না বললেই নয়। লেটনাইট করে ফেরার সময় সংবাদকর্মীদের প্রায়ই গাড়ি নিয়ে ঝক্কি পোহাতে হয়। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। অফিস থেকে নেমে তিনি আগে সবার গাড়ির বন্দোবস্ত করতেন। সবার যাত্রা নিশ্চিত হলেই উঠতেন গাড়িতে। আমার দেশ, ইত্তেফাকসহ যত পত্রিকায় তার সঙ্গে কাজ করেছি, সবগুলোতেই বিষয়টি ছিল তার নিয়মিত রুটিন। বাবু ভাই না থেকেও যেন আছেন আমাদের সঙ্গে তার প্রিয় বার্তাকক্ষে। হয়তো দূর থেকে তিনি দেখছেনও! তাই তো প্রতিদিন তার মতোই ছাপা পত্রিকা হাতে ঘরে ফেরা, প্রতিক্ষণ সংবাদের মধ্যেই ডুবে থাকা।
লেখক: অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক
দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন