সরস্বতী নামের অর্থ জ্যোতির্ময়ী। বৈদিক ঋষিরা ‘জ্যোতি’ শব্দের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাধারণভাবে ‘জ্যোতি’ মানে আলো। আবার জ্যোতিকেই জ্ঞানরূপে অলংকৃত করেছে ‘বেদ’। ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদ বলছে, ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’। অর্থাৎ, হে পরমপুরুষ আমাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে চলো। এই আলো হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানের আলো। অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে যাত্রার আকুতি উপনিষদের ছত্রে ছত্রে বর্ণিত হয়েছে। দেবী সরস্বতীকে তাই বলা হয় জ্যোতির্ময়ী। অর্থাৎ তিনি জ্ঞান শক্তিতে পরিপূর্ণা।
সরস্বতী কথাটি এসেছে সরস্ শব্দ থেকে। সরস্+বতী=সরস্বতী। সরস যার মধ্যে আছেন তিনিই সরস্বতী। সরস অর্থে যেমন জল তেমনই জ্যোতি। শব্দের মৌলিক অর্থ তাই জ্যোতির্ময়ী ও সলিলময়ী। এ জ্যোতি হচ্ছে ব্রহ্মজ্যোতি—স্বর্গলোকে তিনি সূর্যরূপে, ভুবর্লোকে তিনি হিরণ্য দ্যুতি বিদ্যুৎরূপে এবং ভূলোকে অগ্নিরূপে জ্যোতির প্রকাশ। তিনি বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, সর্বশুক্লা, পদ্মাক্ষী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া প্রভৃতি নামে অভিহিতা।
ঋগ্বেদে বাগ্দেবী ত্রয়ীমূর্তি, ভূঃ ভুবঃ স্বঃ, জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী। বিশ্বভুবন প্রকাশ তারই জ্যোতিতে। হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্বলিত হয়, তখন জমাট বাঁধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার দূর হয়ে যায়। অন্তরে, বাইরে সব জায়গায় তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি।
ঋগ্বেদের সরস্বতী সূক্তে (১/৩/১০-১২) সরস্বতী শব্দের ব্যাখ্যায় সায়ানাচার্য্য বলেছেন, শ্বেতবর্ণের মধ্যে তার জ্যোতির রূপই প্রস্ফুটিত। জ্ঞান ও বিদ্যা হচ্ছে সত্ত্বগুণের প্রকাশ। ঋগ্বেবেদ আরও আছে, ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’, সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ বা ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন এ ধরাতে। কালের বিবর্তনে সরস্বতী তার অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন।
পুরাণ অনুযায়ী শুক্লা পঞ্চমীর মাহেন্দ্রক্ষণে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দিনটি শিক্ষা শুরু করা বা কোনো নতুন শিল্প শুরু করার জন্য শুভ বলে মনে করা হয়। শিশুদের হাতেখড়িও দিয়ে থাকে অনেকে। এই শুক্লা পঞ্চমী তিথিকে বসন্ত পঞ্চমী, শ্রীপঞ্চমী, সরস্বতী পঞ্চমী, ঋষি পঞ্চমী নামেও পরিচিত। শুক্লা পঞ্চমীর তিথিতেই ব্রহ্মার মুখ থেকে বিদ্যা ও বুদ্ধির দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি। এই দিনে দেবী সরস্বতীকে সম্পূর্ণ আচারের সঙ্গে পূজা করলে তিনি প্রসন্ন হন এবং ভক্তদের মনের ইচ্ছা পূরণ করেন। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, যেমন—অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ, বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতা ও দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। গ্রামাঞ্চলে এ প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। বর্তমানে অধিকাংশ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস, হাসপাতাল, মহল্লায়, ঘরে ঘরে সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে।
পুরাণে বলা হয়েছে—দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাত। তিনি বাক্য, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিদ্যা ইত্যাদির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ওই গ্রন্থের মতে, সরস্বতী পূজার প্রবর্তক ব্রহ্মা ও শ্রীকৃষ্ণ। তবে পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন—‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন’। আজ থেকে চার হাজার বছর আগের ভারতবর্ষে বয়ে যেত সরস্বতী নদী। এই নদীটিকে বলা হয় দেবী সরস্বতীর ধরিত্রী-রূপ। কথিত আছে, ক্ষত্রিয় বিনাশের পর পরশুরাম এই নদীতে স্নান করে ‘শুদ্ধ’ হয়েছিলেন।
সরস্বতীর বর্তমানে দুটি বাহু। অতীতে চার বাহুর সরস্বতী দেখা যেত। চার হাত মানে হাতগুলো ব্রহ্মার চারটি মাথাকে প্রতীকীভাবে প্রতিফলিত করে, যা মানস (মন, ইন্দ্রিয়), বুদ্ধি (বুদ্ধি, যুক্তি), চিত্ত (কল্পনা, সৃজনশীলতা) এবং অহংকার (আত্মচেতনা, অহং) প্রতিনিধিত্ব করে। ব্রহ্মা বিমূর্তকে প্রতিনিধিত্ব করেন, যখন তিনি কর্ম ও বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। আরেক অর্থে চার হাতের এক হাতে পুস্তক (বই বা লিপি), একটি মালা (জপমালা, মালা), একটি জলের পাত্র এবং একটি বাদ্যযন্ত্র (বীণা)। সরস্বতীর ধারণ করা বই বেদের প্রতীক যা বিশ্বজনীন, ঐশ্বরিক, শাশ্বত এবং সত্য জ্ঞানের পাশাপাশি সব ধরনের শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। স্ফটিকগুলোর একটি মালা, ধ্যানের শক্তি, অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। জলের একটি পাত্র সঠিক থেকে ভুল, শুচিকে অশুচি থেকে এবং অপ্রয়োজনীয় থেকে সারাংশকে আলাদা করার বিশুদ্ধ করার শক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে। জলের পাত্র হলো সোমরসের প্রতীক এমন পানীয়, যা মুক্ত করে এবং জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়।
সরস্বতীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বীণা নামক একটি বাদ্যযন্ত্র, যা সব সৃজনশীল শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তার ধারণ ও জ্ঞান প্রকাশের প্রতীক যা সাদৃশ্য তৈরি করে। সরস্বতী অনুরাগের সঙ্গেও যুক্ত, সংগীতের প্রতি ভালোবাসা এবং ছন্দ, যা বক্তৃতা বা সংগীতে প্রকাশিত সব আবেগ ও অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করে।
সরস্বতী দেবীর পায়ের কাছে রাজহাঁস দেখা যায়। হিন্দু পুরাণে, রাজহাঁস একটি পবিত্র পাখি, যে পাখি দুধ এবং জলের মিশ্রণ থেকে আলাদা করে দুধ পান করতে পারে। এভাবে এটি ভালো ও মন্দের মধ্যে বৈষম্য করার ক্ষমতার প্রতীক, বাহ্যিক প্রদর্শন থেকে সারাংশ এবং অদৃশ্য থেকে চিরন্তন। রাজহাঁসের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কারণে সরস্বতীকে হংসবাহিনী নামেও অভিহিত করা হয়। রাজহাঁস আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা, অতিক্রম ও মোক্ষের প্রতীকও।
ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতী বিদ্যার ও ললিতকলার দেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছেন সেই আদিকাল থেকে। কিন্তু ভারতবর্ষের বাইরেও দেবী সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। যবদ্বীপে পাওয়া পদ্মাসনে বসা সাত তারের বীণা হাতে সরস্বতী দেবীর মূর্তি, তিব্বতে বজ্রধারিণী ময়ূর নিয়ে বজ্র সরস্বতী দেবী ও বীণাপাণি দেবী সরস্বতী, জাপানে বেনতেন নামধারিণী সর্পাসনা দ্বিভুজা বীণাপাণি, অষ্টভুজা হপ্পিবেনতেন সরস্বতী দেবী। চীনদেশে শস্যদেবী কুয়ানযিনের সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করা যেতে পারে। কেউ কেউ আবার মধ্যপ্রাচ্যের মাতৃকাদেবী ইস্তার বা ইনান্নার সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করেছেন। গ্রিক দেবী এথেনির সঙ্গে দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য অনেকে কল্পনা করে থাকেন। তবে রোমীয়দেবী মিনার্ভার সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। আইরিশ দেবী ব্রিঘিদ কাব্য, শিল্প ও আরোগ্যের দেবী হিসেবে মিনার্ভার প্রতিরূপ। রোমারদেবী মিনার্ভা ও কেলটিক দেবী বিঘ্রিদের সঙ্গে প্রকৃতিগত দিক থেকে দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য আছে ঠিকই, তবে এ দুই দেবীর সঙ্গে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর সম্পর্ক নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কেবল জাপানি বিদ্যাদেবী বেনতেন যে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর বিদেশে আতিথ্য গ্রহণের সাক্ষ্য, এটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বিদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রুঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিক মন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অন্য জ্ঞানগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ