বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:২৪ এএম
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শবেবরাতের মাহাত্ম্য ও আমল

শবেবরাতের মাহাত্ম্য ও আমল

ইসলামী ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস শাবান। এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতই হচ্ছে শবেবরাত। শবেবরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। অতএব ‘শবেবরাত’ অর্থ মুক্তির রজনী। ‘শবেবরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাত’, যা কোরআনুল কারিমে বিদ্যমান। হাদিসের ভাষায় বলা হয় ‘লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য রজনী। ভারত উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে এ রাত ‘শবেবরাত’ নামেই বেশি পরিচিত। শবেবরাতকে যে নামেই ডাকা হোক, মূল বিষয় এক ও অভিন্ন, যা কোরআনের আয়াত ও অসংখ্য সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহতায়ালা মুমিনদের রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের জন্য বছরের যে কয়েকটি রাতকে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে দিয়েছেন, লাইলাতুল বরাত সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। শবেবরাতে আল্লাহতায়ালা তার অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করেন, সেজন্য একে মুক্তির রাত বলা হয়। এ রাতকে লাইলাতুল মোবারাকা অর্থাৎ বরকতময় রাত, ‘লাইলাতুস সাক’ তথা পুরস্কারের সনদ প্রাপ্তির রাতও বলা হয়ে থাকে। (তাফসির কুরতুবি : ১৯/৯৯-১০৩)।

শবেবরাত সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, নিশ্চয়ই আমি এটিকে বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে বণ্টন করে দেওয়া হয় প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়।’ (সুরা দুখান: ১-৩)। বিখ্যাত তাবেয়ি ইকরামা (রা.) ও একদল মুফাসসিরের মতে, লাইলাতুল মোবারাকা বা বরকতময় রাত হলো শাবানের মধ্যরাত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘লাইলাতুল মোবারাকা’ হলো শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। আর সেটাই লাইলাতুল বরাত।’ (তাফসিরে দুররে মানসুর: ৭/৪০১)। শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যখন অর্ধশাবানের রাত আসে, তোমরা এ রাতকে ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করো এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহতায়ালা প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। রিজিক প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি রিজিক প্রদান করব? কে বিপদগ্রস্ত আছে? আমি বিপদমুক্ত করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে আহ্বান করতে থাকেন।’ (ইবনে মাজা: ১৩৮৮)। আল্লাহর রাসুল (সা.) এ রাতে বিশেষ ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, কবর জিয়ারত ইত্যাদি আমলে ব্যস্ত থাকতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি এক রাতে উঠে দেখি নবীজি (সা.) ঘরে নেই। তখন আমি তাকে খুঁজতে ঘর থেকে বের হয়ে বাকিতে (মদিনার কবরস্থান) পেয়েছি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি ভয় করো যে আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! মূলত তা-ই নয়। বরং আমি মনে করেছি, আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট এসেছেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং কালব গোত্রের বকরির সমুদয় পশমের চেয়েও বেশি গুনাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি: ৭৩৯; ইবনে মাজা: ১৩৮৯)

বিখ্যাত তাবেয়ি খালিদ বিন মাদান, মকহুল, লোকমান বিন আমের (রহ.) প্রমুখ প্রসিদ্ধ তাবেয়িরা মধ্য শাবানের রাতকে সম্মান করতেন এবং এতে স্বাভাবিক অভ্যাসের চেয়েও বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতেন। (লাতায়েফুল মায়ারিফ: ২৬২)। তাবেয়ি আতা ইবনে ইয়াসার (রহ.) বলেন, ‘লাইলাতুল কদরের পর শাবানের পঞ্চদশ রাত অপেক্ষা উত্তম রাত আর নেই।’

ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, বছরের পাঁচটি রাতে দোয়া কবুল হয়। জুমার রাত, দুই ঈদের দুই রাত, অর্ধশাবানের রাত এবং রজব মাসের প্রথম রাত। (কিতাবুল উম্ম: ২/৪৮৫)। ইমাম ইবনে নুজাইম মিসরি (রহ.) বলেন, রমজানের শেষ দশকের রাত, দুই ঈদের রাত, জিলহজের প্রথম দশকের রাত, অর্ধ শাবানের রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। কারণ এর সপক্ষে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (আল বাহরুর রায়েক: ২/৫৬)। নবীজি, সাহাবি ও তাবেয়িদের আমল দেখে সে যুগের মক্কার লোকেরাও শবেবরাতে রাতভর ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। শবেবরাতে মক্কার অধিবাসীদের আমল সম্পর্কে আল্লামা আবু বকর ফাকেহি (২১৭-২৭৫হি.) বলেন, অতীত কাল থেকে আজ পর্যন্ত আহলে মক্কার বা মক্কাবাসীর আমল ছিল যে, অর্ধশাবানের রাতে সাধারণ মানুষ মসজিদুল হারামের উদ্দেশে বের হতো। তারা নামাজ আদায় করত, তাওয়াফ করত এবং সারা রাত ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করত। এমনকি সকাল পর্যন্ত কোরআন তেলাওয়াত, খতমে কোরআন এবং নামাজের মাধ্যমে অতিবাহিত করত। নামাজের মধ্যে তারা প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহা এবং ১০ বার সুরা ইখলাস পড়ত। তারা জমজমের পানি পান করত, তা দিয়ে গোসল করত এবং অসুস্থদের জন্য জমা করে রাখত। উদ্দেশ্যে ছিল এই রাতের বরকত হাসিল করা। (আখবারে মক্কা: ৩/৮৪)

তবে বিশেষ এ রাতেও কিছু মানুষ রহমত-বরকত থেকে বঞ্চিত হন। কিছু কিছু এমন গুনাহ রয়েছে, তা তাওবা ছাড়া মাফ হবে না। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)।

শবেবরাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন বান্দার জন্য অনেক বড় অনুগ্রহ। এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি থেকে দূরে থাকা ইমানদারের কাজ নয়। এ রাতে আমরা যেসব আমল করতে পারি তা হলো, নফল নামাজ আদায় করা, কোরআন তেলাওয়াত করা, তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা, তওবা-ইস্তেগফার করা, দরুদ শরিফ পাঠ করা, জিকির-আসকারে নিয়োজিত থাকা, প্রার্থনায় সবার কল্যাণ কামনা করা, কবর জিয়ারত করা, দান-সদকা করা এবং পরদিন রোজা পালন ইত্যাদি ইবাদতে মশগুল থাকা। কিন্তু আমাদের দেশে অনেককে দেখা যায়, এ রাতে হালুয়া-রুটি, গোশতসহ বিভিন্ন ধরনের মজাদার খাদ্য তৈরি করে আত্মীয়স্বজন নিয়ে মহাব্যস্ত সময় পার করে ইবাদত-বন্দেগির সময়-সুযোগ হারিয়ে ফেলে। এটা কখনোই একজন মুমিনের কাম্য হতে পারে না। শবেবরাত যেহেতু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন বান্দার জন্য এক বিশেষ অনুগ্রহ; তাই এই রাতে বিভিন্ন গর্হিত কাজ থেকেও আমাদের দূরে থাকতে হবে; যেমন—আতশবাজি ফোটানো, খেলাধুলায় মত্ত থাকা, ঘরবাড়িতে আলোকসজ্জা করা, শরিয়তবিরোধী কাজ করা, অপচয় করা, কারও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো, অযাচিত আনন্দ-উল্লাস করা, বেহুদা কথাবার্তা ও ঘোরাঘুরি করা, সাওয়াবের উদ্দেশ্য মসজিদে খিচুড়ি রেঁধে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করা। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পুণ্যময় রজনীর বরকত হাসিল করার তওফিক দান করুন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

একাধিক উপকারিতা কাঠবাদামের, যাদের জন্য ক্ষতিকর

একই দিনে দুইবার পরিবর্তন, রাকসু নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ

পারকি সৈকতের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ

১০

জয়পুরহাটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুর্ধর্ষ চুরি

১১

হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের নামে প্রতারণা, সতর্ক থাকার নির্দেশ

১২

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের প্রচারণার ভিডিওতে থাকায় বিপাকে শেবাগ

১৩

ভারতের ছাড়া পানি থেকে বাঁচতেই বাঁধ উড়িয়ে দিল পাকিস্তান!

১৪

সিলেটে পানির জন্য হাহাকার, সড়ক অবরোধ

১৫

অপারেশনের পর জ্ঞান না ফেরায় রোগীর মৃত্যু

১৬

শাহপরাণ (রহ.)-এর মাজারে ওরস বৃহস্পতিবার

১৭

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য পুলিশ ‘ক্ষমা’ চাইবে, জানালেন ফাওজুল কবির

১৮

নদীভাঙন এলাকা পরিদর্শনে গেলেন উপদেষ্টা শারমিন মোরশেদ

১৯

বাবরকে নিয়ে মন্তব্য করায় হারিসকে লাঠি দিয়ে মারতে চান সাবেক পাক ক্রিকেটার

২০
X