বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত রচনায় ক্ষুদ্র উদ্যোগের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৯০ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের উপায় হিসেবে কাজ করছে। তা ছাড়া বর্তমানে দেশের মোট জনশক্তির ৫৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের ২৫ শতাংশই এ খাত থেকে অর্জিত হয়। পরিবেশবান্ধব ব্যবসা সম্প্রসারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পরিবেশবান্ধব টেকসই চর্চা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য কাজ করেছে সহায়তায় পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট (এসইপি)। এই প্রজেক্টের আওতায় প্রায় ৬৫ হাজার উদ্যোক্তার নানারকম সহায়তা দেওয়া হয়েছে যার প্রায় ৮৪ শতাংশ ছিল নারী উদ্যোক্তা। গত ছয় মাস শতাধিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সঙ্গে কালেকটিভ ইন্টেলিজেন্স ওয়ার্কশপের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য কী করা প্রয়োজন, তা জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। এ লেখায় মাঠপর্যায়ে নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন উপস্থাপন করা হয়েছে।
গত ছয় মাস বাংলাদেশে নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে একইরকম গল্প শুনেছি। গল্পগুলোকে সহজ করে উপস্থাপন করলে দেখা যাবে সব গল্পের সারমর্ম একই—উদ্যোক্তা হতে চাইলে সবচেয়ে বড় বাধা আসে পরিবার থেকে। রংপুরের নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ইয়াসমিন বেগম (ছদ্মনাম) তার ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরুর গল্প বললেন এভাবে, ‘ব্যবসা করতে চাই শুনে পরিবারের সদস্যরাই বিরোধিতা করেছিলেন। তবে আমার বৃদ্ধ বাবা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে আমার হাতে ৫০০ টাকা তুলে দিয়েছিলেন। এ ৫০০ টাকা দিয়েই শুরু করি আমার প্রতিষ্ঠান। কিছু পুঁতি আর লেইস কিনে এনে আমি নিজে পণ্য বানিয়ে বিক্রি করেছিলাম স্থানীয় একটি মেলায়। লাভ হয়েছিল তিনগুণ। আজ ১০ বছর পর আমার প্রতিষ্ঠানে ১০ জন কর্মী কাজ করেন। আমি স্বপ্ন দেখি আরও বড় প্রতিষ্ঠান গড়ার।’
কোনো না কোনোভাবে নারীরা পারিবারিক বাধা অতিক্রম করলেও তার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পুঁজির সংকট। যশোরের নারী উদ্যোক্তা রাহেলা বলছিলেন, ‘কভিড-১৯ অতিমারির সময় সরকার আমাদের মতো নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের রক্ষায় বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করল। তখন ব্যাংকে যোগাযোগ করলাম। সব ব্যাংক থেকেই জামানত চায়। অথবা অন্তত একজন সরকারি কর্মকর্তার নাম গ্যারান্টার হিসেবে দিতে বলে। পরিবারেই অনুমতি পাই না ব্যবসা করার, গ্যারান্টার পাব কোথায়?’
সারা দেশে, সবখানেই নারী উদ্যোক্তাদের সমস্যা প্রায় একই। তাদের গ্যারান্টি দেওয়ার মতো সম্পত্তি নেই। কেন সম্পত্তি নেই নারীদের? বগুড়ার একজন নারী উদ্যোক্তা বলছিলেন, ‘সম্পত্তি থাকবে কোত্থেকে বলুন তো? যেটুকু সম্পত্তি বাবা-মা দিয়েছেন তা নিতে চাইলেই তো ভাইদের ঘুম হারাম। দিলেও এমন সম্পত্তি দেয় যে তা না করা যায় বিক্রি, না রাখা যায় মর্টগেজ।’
রংপুরের নারী উদ্যোক্তা সুফিয়া আফসার বললেন অন্য সমস্যার কথা, ‘সম্পত্তি বা গ্যারান্টার থাকলেও ঋণ নেওয়ার সময় দেখাতে হবে পণ্যের মজুত।’ তিনি বলছিলেন, ‘ব্যাংকের কর্মকর্তার পরামর্শে আমি পণ্যের মজুত গড়ে তুললাম। তখনই শুরু হয়ে গেল কভিড-১৯ অতিমারি। তিনি আর ঋণ দিলেন না। এদিকে ওগুলো ছিল নিত্যব্যবহার্য পণ্য, যা বেশি দিন গোডাউনে রাখা যায় না। তৈরির পর সব বিক্রি না করতে পারায় নষ্ট হয়ে গেল। ঋণ তো পেলামই না, যা পুঁজি তৈরি করেছিলাম পাঁচ বছরে তার একটা বড় অংশ হারালাম। আমি সবসময়ই নিশ্চিত ছিলাম যদি আমাকে ঋণ দেওয়া হয়, নিশ্চিত তা ফেরত দিতে পারব। কিন্তু সেই ঋণ আর পেলাম না।’
রংপুরের এই নারী উদ্যোক্তার কথা যে সঠিক তা এসইপি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের হার দেখলেই বোঝা যায়। কোনোরকম জামানত বা পণ্যের মজুত ছাড়াই এ নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পেয়েছেন এবং তারা সবাই যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করেছেন।
কক্সবাজারের নারী উদ্যোক্তা সুমনা আক্তার বলছিলেন, ‘ব্যবসায়িক উদ্যোগে নারীর সম্পৃক্ততার জন্য সব বাধা ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পিকেএসএফের এসইপিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং পুঁজি দিয়ে যে সাহায্য করেছে বা করছে, তার গুরুত্ব অপরিসীম।’
আমাদের কালেকটিভ ইন্টেলিজেন্স ওয়ার্কশপগুলোয় যে নারী উদ্যোক্তারা ছিলেন তারা পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ ব্যবসা গড়ে তোলায় তাদের সাফল্যের জন্য যে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো—১. পরিবেশ রক্ষায় নারীর সহজাত প্রবৃত্তি; ২. অদম্য সাহস ও হার না মানার মানসিকতা; ৩. উদ্ভাবনী মনোভাব; ৪. যোগাযোগ দক্ষতা; ৫. পণ্য উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধির সক্ষমতা এবং ৬. ব্যবসা বৃদ্ধির সুযোগ গ্রহণের সক্ষমতা।
পরিবেশবান্ধব উদ্যোক্তা হওয়ার পথে নারীর মূল সমস্যা হিসেবে তারা বেশ কিছু বিষয় চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, পারিবারিক সহযোগিতার অভাব এবং পুঁজির সমস্যা ছাড়াও তারা যে সমস্যার মুখোমুখি হন সেগুলো হলো—প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগের অভাব, ব্যবসার জন্য লাইসেন্স বা প্রয়োজনীয় সরকারি ছাড়পত্র পেতে সমস্যা হওয়া, ব্যবসা সম্প্রসারণের সময়োপযোগী যথোপযুক্ত পরামর্শ ও সহযোগিতা না পাওয়া, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতার অভাব এবং দেশ-বিদেশে পণ্য বিক্রির উদ্যোগে সম্পৃক্ত হতে না পারা।
পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ ব্যবসা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরুষ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের মূল সমস্যাটি প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে সাভারের নারী উদ্যোক্তা শেফালি বলেন, ‘গত ১২-১৪ বছর কঠোর পরিশ্রম করে আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। জমি কিনে ফ্যাক্টরি দেওয়ার অভিপ্রায়ে যখন জমি খোঁজা শুরু করলাম, তখন দেখি অন্য সমস্যা। অতীতে যারা বিরোধিতা করেছেন, ব্যবসায় যুক্ত হতে তারাই এখন সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতা। আবার একা জমি কিনতে গেলে বিক্রেতা প্রশ্ন করেন, এত টাকা কোথায় পেলাম, কীভাবে পেলাম যে জমি কিনছি? এরকম প্রশ্ন এই সমাজ আর কতদিন করবে বলতে পারেন?’
প্রশ্নটির ভেতর নারীর কষ্ট, নারীর ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সক্ষমতাকে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় তা ভীষণ অপমানের, শুধু নারীর জন্যই নয়, এ সমাজের জন্যও। নারী উদ্যোক্তাদের কাছে সাফল্যের যে গল্প শুনেছি তাতে এটুকু বলা যায়, এ দেশে নারী সমাজের এক বড় অংশ এখনো নিজে ভালো থাকব এ চিন্তা বা ইচ্ছা থেকে ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেন না; বরং তারা বাধ্য হন। সাতক্ষীরার একজন নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘সংসার ভালোই চলছিল। আমার স্বামী হঠাৎ করে মারা গেলেন। তিনটি সন্তান; কে খাওয়াবে? বাধ্য হয়ে আমিই ব্যবসার হাল ধরলাম। অনেকেই অনেক কথা বলেছে। কারও কথায় কান দিইনি। আমার সন্তানরা এখন কলেজে পড়ে। আমি জানি আমার ওদের মানুষ করতে হবে।’
সারা দেশের সব নারী উদ্যোক্তাই তাই একবাক্যে বলেছেন, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ ব্যবসা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরুষদের মনোভাব বদলাতে হবে। তারা যেন নারীদের সম্মান দিতে শেখেন। যশোরের নারী উদ্যোক্তা সুদীপ্তা বলছিলেন, ‘এমন কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া যায় না যে পুরুষরা নারী উদ্যোক্তাদের সম্মান করা শিখবে, জানবে। আমাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে না?’ শরীয়তপুরের নারী উদ্যোক্তা ওয়াসিয়া বললেন, ‘এতদিনে আমি শিখে গিয়েছি কীভাবে বাইরের পুরুষদের উপেক্ষা করতে হবে। তবে বিশ্বাস করুন, যদি আমাদের ঘরের পুরুষরা একটু পাশে দাঁড়াত, আমাদের যুদ্ধটা সহজ হয়ে যেত।’
নারী উদ্যোক্তাদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় এই দেশে পরিবেশবান্ধব নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির জন্য পুঁজির জোগানের পাশাপাশি সম্প্রসারিত করতে হবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ, সহজ করতে হবে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স বা প্রয়োজনীয় সরকারি ছাড়পত্র, নিশ্চিত করতে হবে ব্যবসা সম্প্রসারণের সময়োপযোগী যথোপযুক্ত পরামর্শ ও সহযোগিতা, নারীর আয়ত্তে আনতে হবে আধুনিক প্রযুক্তি এবং তাকে দিতে হবে দেশ-বিদেশে পণ্য বিক্রির সুযোগ। আমাদের নারীরা এগোচ্ছেন, এগোবেন। পুরুষ মনোভাব পরিবর্তন করুক আর নাই করুক, নারীরা এগোবেনই। তবে পুরুষদের মনোভাব পরিবর্তন করা গেলে যে নারীর এগোনোর পথটা অনেক মসৃণ হয়ে যায়, তা বারবার করে নারী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। পরিবেশবান্ধব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য নারীর পথচলা সহজ করতে পুরুষদের মনোভাব পরিবর্তন করা প্রয়োজন ভীষণভাবে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ কি তা শুনছে?
লেখক: অধ্যাপক, ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়