দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষার গুণগত মান এবং মানসম্মত শিক্ষা একান্ত দরকার। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো খুবই জরুরি। দেশের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাসের হার প্রতি বছর বাড়লেও শিক্ষার্থীর মেধা সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দেশের ও সমাজের অনেকেরই। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক মহলের মধ্যে একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় তা হলো জিপিএ ৫। তাদের ধারণাটা এমনই যে, পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া মানে মহাকাশ জয় করা। আপনাকে আমাকে এটি স্মরণ রাখতে হবে যে, তাদের মেধা বা প্রতিভা সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে কি না? লোক দেখানো জিপিএ ৫ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশ ও জাতি একদিন গভীর সামাজিক সংকটের মুখে পড়তে পারে বা পড়বে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি গড়ে তুলতে পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ পরিবারেই এসবের বীজ প্রোথিত হয়। এ ছাড়া সামাজিক পরিবেশ দেখে শিশুরা অনেক কিছু শেখে। এজন্য সমাজকে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। সামাজিক কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতিও শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে। তাই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সব স্তরে নিয়মিত দেশের কৃষ্টি-কালচারবিষয়ক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি শক্ত ভিত গড়ে উঠবে।
এ ছাড়া ধর্মের প্রকৃত পাঠই শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এ ক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ যাতে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশের বিষয়টি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের ত্রিভুজ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘মানুষ করে তোলাই শিক্ষা’। এখন ভালো মানুষ হলো ‘যে কখনই কারও কোনো ক্ষতি করে না, সকলের প্রতি সহমর্মিতার মানসিকতা পোষণ করে এবং তার ওপর অর্পিত পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে।’ আমাদের সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
এ বিষয়ে শিক্ষকদের ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘আমি আমার বাবার কাছে ঋণী জীবনের জন্য, কিন্তু আমার শিক্ষকের কাছে ঋণী সুন্দর জীবনের জন্য।’ তাই ‘ভালো মানুষ গড়া’ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ও পবিত্র দায়িত্ব হওয়া উচিত। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য লেখাপড়া, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শিক্ষা কার্যক্রমে সুপরিকল্পিত নৈতিকতা শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি।
সালাম দেওয়া সম্পর্কে হজরত মোহাম্মদ (স.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে পরিচিত-অপরিচিত সকলকে খেতে দেয় এবং সালাম প্রদান করে’ (বোখারি ও মুসলিম)। সালাম দেওয়া মানুষকে বিনয়ী করে এবং অন্যের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এজন্যই সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং সিনিয়র ভাইবোনকে সালাম দেওয়া সব শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যক করা উচিত।
বিদ্যালয়গুলোতে অ্যাসেমব্লির শুরুতে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট তরজমাসহ আয়াত পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করা হয়ে থাকে। পরে জাতীয় পতাকাকে সালাম প্রদানের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। এর পরে সবাই নিম্নলিখিত শপথ বাণী পাঠ করে, ‘আমি শপথ করছি যে, মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখব, দেশের প্রতি অনুগত থাকব। দেশের একতা ও সংহতি বজায় রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকব। অন্যায় ও দুর্নীতি করব না এবং প্রশয়ও দেবো না। কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করব না। প্রতিদিন কমপক্ষে একটি ভালো কাজ করব। হে আল্লাহ! আমাকে শক্তি দাও, আমি যেন বাংলাদেশের সেবা করতে পারি এবং বাংলাদেশকে একটি আদর্শ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। আমিন!’ এরপর পরম আবেগে দেশপ্রেমে আপ্লুত হয়ে সবাই গেয়ে ওঠে জাতীয় সংগীত—‘আমার সোনার বাংলা...’। পরে প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রেরণামূলক বক্তব্য দেন, যেখানে তিনি বারবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন পিতা-মাতা, পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক : সহকারী শিক্ষক, ইংরেজি, দুর্গাপুর হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ