চাঁদপুরের মতলবের মেঘনা নদীতে এখন আর দেখা মিলছে না ইলিশ কিংবা অন্য মাছের। নদীতে দিনভর জাল ফেলেও অনেক জেলে ফিরছেন খালি হাতে। এতে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে মেঘনা নদীকেন্দ্রিক হাজারো জেলে পরিবার। আয় নেই, অথচ এনজিও ও স্থানীয় মহাজনের ঋণের কিস্তির চাপ বাড়ছে প্রতিদিন।
স্থানীয় সচেতন মহল জানান, এ এলাকার প্রকৃত জেলেদের তালিকা করে সরকারি সহায়তা নিশ্চিত, নদী দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ, বিকল্প পেশার জন্য প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা, কিস্তির টাকা পরিশোধে সময়সীমা বাড়ানো ও সুদ মওকুফ করলে জেলেদের জীবন-জীবিকার মান বৃদ্ধি পেত।
মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুর, ষাটনল, এখলাসপুর, বাবু বাজার, আমিরাবাদ বাজার, জহিরাবাদ, দশানীসহ নদীপাড়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, জেলেদের চোখে-মুখে হতাশা আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য কিছু করার চিন্তাও করছেন।
মোহনপুর গ্রামের জেলে আবুল হোসেন বলেন, ‘নদীর পানিতে এখন গন্ধ হইতাছে। পচা পানি হইছে। মাছ ডিম পাইলেও মরতাছে। এ জন্য মাছ হয় না। এখন বাইম-শিংও পাওয়া যায় না। সংসার চালাইতে খুবই কষ্ট হইতাছে।’
একই গ্রামের কাইল্লা বেপারী জানান, আগে দিনে ৮-১০ কেজি মাছ পাইতাম। এখন সারাদিন নদীতে গিয়া ৫০ টাকারও মাছ ধরি না। এই টাহায় কি চাল কিনুম, না কিস্তি দিমু?
ফতোয়াকান্দি গ্রামের মাসুদ মিয়া বলেন, ‘আমার দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার কিস্তি রইছে। মাছ না থাকায় এখন আর শোধ দিতে পারতাছি না। শুধু চিন্তায়ই থাকি, কেমনে এই দেনা শোধ করুম।’
জেলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘নৌকার তেল লাগে দিনে ৩০০ টাকা। কিন্তু সারাদিন জাল টানার পর ২০০ টাকারও মাছ উঠে না। যা পাই, তা ঘরের জন্যই লাগে। এখন ভাবতাছি, এই পেশা ছাড়ুম।’
ষাটনল জেলে পাড়ার অটল বর্মণ জানান, আমরা নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরি না। মা ইলিশের সময় হইলেও নদীতে যাই না। কিন্তু নিষেধ না থাকলেও জাল নিয়া নদীতে গেলে নানা ঝামেলা হয়। তখনও আমাদের শান্তি নাই।
জেলেরা বলছেন, মেঘনার পানির গুণগত মান খারাপ হয়ে যাওয়ায় মাছের বংশবৃদ্ধি কমে গেছে। আবার নদীতে অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে চায়না দুয়ারি, কারেন্ট জাল ও অবৈধ চাঁই। ফলে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, নদীতে বড় বড় ট্রলারে মাছ ধরা হয়, যেগুলোতে ব্যবহৃত হয় আধুনিক জাল ও প্রযুক্তি। অথচ ক্ষুদ্র জেলেরা প্রতিদিন নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন।
বাবু বাজারের মৎস্য আড়তদার রাজিব খান বলেন, মাছের সরবরাহ খুব কম। আগে প্রতিদিন ৫০ জন মাছ দিত, এখন হাতে গোনা কয়েকজন আসে।
ক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, শুধু ইলিশ না, সব মাছের দামই এখন বাড়তি। রুই, কাতলা, পাঙাশ সবই ৩০০-৪০০ টাকা কেজি। বাজারে গেলে মাছের দিকে তাকানোই যায় না।
এ বিষয়ে মতলব উত্তর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস কালবেলাকে বলেন, নদীর পানির মান খারাপ হওয়া, অপরিকল্পিত নিষেধাজ্ঞা এবং অবৈধ উপকরণের ব্যবহারের কারণে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি অবৈধ জাল ও চাঁই অপসারণে।
তিনি বলেন, এখন বর্ষার সময়, এটি মাছের মৌসুম। আমরা আশাবাদী, কয়েক দিনের মধ্যেই মেঘনা নদীতে মাছের পরিমাণ বাড়বে। জেলেরা নতুন করে মাছ ধরতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, মেঘনা নদী এক সময় জেলেদের জীবন চলার বড় ভরসা ছিল। এখন সেই নদীই যেন তাদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলেরা বলছেন, নদী আগে দিত, এখন শুধু নেয়। আমরা চাই, আবার আগের মতো নদীতে মাছ হোক, আমরাও শান্তিতে বাঁচি।
মন্তব্য করুন