সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৭ এএম
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৮:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় পার্টি কি দেশের রাজনীতির অংশীজন

জাতীয় পার্টি কি দেশের রাজনীতির অংশীজন

আবারও ভাঙন ঘটল জাতীয় পার্টিতে। ‘জাতীয় সম্মেলন’ করে জি এম কাদেরের বাইরে গিয়ে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান এবং কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

আপাতত এটুকু খবর এই দলের পক্ষ থেকে। তবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এসেছে জি এম কাদেরের অংশ থেকে। এক সংবাদ সম্মেলন করে জি এম কাদেরের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘বিষয়টা আমরা আমলে নিচ্ছি না। কারণ তিনি (রওশন এরশাদ) এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউ না। আমাদের গঠনতন্ত্রে তার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো অধিকার নেই।’

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা পতিত স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদ বেঁচে থাকতেই দল ভেঙেছে, বহিষ্কার পাল্টা বহিষ্কারের অসংখ্য নাটক হয়েছে। তার মৃত্যুর পর সেটা আরও বেড়েছে। বহিষ্কার করা, তিরস্কার করা এই দলে স্বাভাবিক ঘটনা। এগুলো নিয়মিতই ঘটছে। বহুদিন ধরেই দলকে কেন্দ্র করে দেবর-ভাবির নানা বিবাদও চোখে পড়ছে।

এই যে আমরা দল বলছি, সেটাও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যাকে ‘দল’ বলে, জাতীয় পার্টি বা জাপা তার জন্মলগ্ন হতে সে সংজ্ঞায় পৌঁছতে পারেনি। প্রকৃত প্রস্তাবে জাপা এরশাদের ক্ষমতা আর বিপুল বিত্তকে কেন্দ্র করে জমে ওঠা বিবিধ নেতার এক অসংজ্ঞায়িত ভিড়।

জাপার এখন নতুন ব্র্যাকেট রওশন এরশাদ। কিন্তু তার জন্য এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে এই ব্র্যাকেট নিয়ে। প্রথমত তিনি নিজে বয়সের ভারে ন্যুব্জ। একেবারেই চলতে-ফিরতে পারছেন কম। দ্বিতীয়ত বৈধতার প্রশ্ন জি এম কাদের এগিয়ে থাকবেন, কারণ তার অংশটা সংসদে আছে এবং দলের প্রতীক নিয়েই আছে। রওশন এরশাদের সঙ্গে যারা আছেন তারা তেমন একটা সাংগঠনিক সক্ষমতাও দেখাতে পারেননি নতুন উদ্যোগে। গত ৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের বাইরে যে সম্মেলনের আয়োজন করেন রওশন এরশাদপন্থিরা সেটায় রাজধানী ও আশপাশের এলাকার লোক সমাগম ছিল বেশি। জেলা পর্যায় থেকে নেতাকর্মীদের আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। দলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরের কেউ আসেননি সম্মেলনে। উত্তরের জনপদ থেকে নামেমাত্র প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন।

এটা ঠিক যে, রওশনের সঙ্গে কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা আছেন এবং তারা পদও পেয়েছেন। যেমন কাজী ফিরোজ রশীদ নির্বাহী চেয়ারম্যান, আবু হোসেন বাবলা সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, সাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার ও সুনীল শুভরায়কে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে।

এ ভাঙনটা হয়েছে নির্বাচন কেন্দ্র করেই; যদিও এর মধ্যে নির্বাচন পার হয়ে গেছে এবং সংসদও কার্যকর হয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে বড় সংকট দেখা গিয়েছিল। জি এম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন নির্বাচনে অংশ নেননি। জি এম কাদের কাজী ফিরোজ রশীদ বা আবুল হোসেন বাবলার মতো বড় নেতাদেরও মনোনয়ন দেননি। ঢাকায় নিজের স্ত্রীকে মনোনয়ন দিলেও তিনি পাস করতে পারেননি। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে রওশনের অনুসারী কাউকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। মূলত এ বঞ্চিতদের নিয়েই নতুন কমিটি গঠন করেছেন রওশন এরশাদ। অবশ্য জি এম কাদেরের অনুসারী বেশ কয়েকজন নেতা-নেত্রীও এসেছেন রওশনের সঙ্গে।

এখন রওশনের দলের প্রতীক কী হবে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন আবেদন নাকচ করলেও আদালতের শরণাপন্ন হবেন তারা। লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টি নামে দল পরিচালনায় আইনি লড়াইয়ে যেতে চান রওশনপন্থিরা। এতে করে রওশনপন্থিরা একটা বড় সময় আলোচনায় থাকলেও সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে জি এম কাদেরের দিকেই লাঙ্গলের পাল্লা ভারী। আরেকটা বিষয় পরিষ্কার যে, জি এম কাদেরকে প্রতীক নিয়ে বিপদে ফেলে সরকার সংসদের বিরোধী দলকে হারাতে চাইবে না।

রওশনের সঙ্গে যারা আছেন তাদের সবাই রওশনকে সামনে রেখে এসেছেন মূলত জি এম কাদেরের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায়। সম্মেলনে রাহগীর আল মাহি এরশাদকে (যিনি সাদ এরশাদ নামে পরিচিত) দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান করা হয় এবং রওশন এরশাদের অবর্তমানে তিনি দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। এর অর্থ হলো, দলের এই অংশটাও এরশাদ পরিবারের হাতেই থাকল।

১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পরও দলটি অনেক দিন দেশের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল। গত তিন মেয়াদ ধরে আওয়ামী লীগের অনুকম্পায় সংসদে থাকছে, এমনকি ক্ষমতার অংশীদারও হয়েছিল। কিন্তু গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে, একই সঙ্গে সরকারি ও বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে থাকতে এটি আর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজের মর্যাদা বা ভাবমূর্তি রাখতে পারছে না।

জি এম কাদেরের অংশ সংসদে আছে এবং আছে সরকারের আনুকূল্যে। কোনো কারণে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে এদের জন্য ভিন্ন পথও সরকার সৃষ্টি করতে পারে, সেই ভয়টাও আছে। দলের কাঠামো একেবারেই ব্যক্তি মালিকানাধীন। চেয়ারম্যান চাইলে যে কাউকে যে কোনো পদে নিয়োগ দিতে পারেন, আবার বহিষ্কারও করতে পারেন।

জাতীয় পার্টির সেই অর্থে কোনো দর্শন নেই। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশে তার কোনো উপস্থিতি নেই। তরুণ সমাজের মধ্যে একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা নেই। বলতে গেলে কোনো আলোচনাতেই নেই। একটা সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পর জাতীয় পার্টিকেই ধরা হতো। অবশ্য কাগজে কলমে জাতীয় পার্টি এখনো সংসদের বিরোধী দল। কিন্তু সত্যিকারের ভোট হলে, বিএনপি যদি থাকে, ইসলামী দলগুলো অংশ নেয় তাহলে জাতীয় পার্টিকে খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর হবে। এবারের বিএনপিবিহীন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ থেকে ২৬টি আসন চেয়ে নিয়ে মাত্র ১১টিতে জিততে পেরেছে।

জনপরিসরে প্রভাবহীন একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদে থাকলেও দলটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা আছে। টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। সরকারের হার্ডলাইনে পর্যুদস্ত বলা যায়। কিন্তু সবরকম সুবিধা নিয়েও জাতীয় পার্টি নিজেকে সেই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারল না, বরং আরও খণ্ডিত ও ছোট হয়েছে।

জাতীয় পার্টির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড, কর্মসূচি, নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দলের আদর্শ সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া যায় না। এই দলের কাছ থেকে জাতীয় কোনো রূপরেখা পাওয়া যায় না, রাষ্ট্রের আগামীর নির্দেশনা পাওয়া যায় না। একটা বিরাট শূন্যতা। কিন্তু কেন এমন হলো? কারণ জাতীয় পার্টি এরশাদের সৃষ্টি এবং এরশাদের মতো তার দলটিও সমাজের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারেনি। শেখ হাসিনা বিশেষ দূতের মর্যাদা দিলেও এরশাদের স্বৈরাচারী ভাবমূর্তি, নারীঘটিত বিষয়সহ তার নানাবিধ আলোচিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে যেমন কোনো সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি, তার দলকেও দেয়নি।

এ কথা ঠিক যে, দলটিতে অনেক সিনিয়র নেতা আছেন। জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু ভালো বক্তৃতা করেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। রওশন অংশের ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা এবং গোলাম সারোয়ার মিলন পরিচিত মুখ। কিন্তু উভয় অংশে এমন কেউ নেই যে, জনপরিসরে এসে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাবেন।

অর্থাৎ জাতীয় পার্টির কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি নেই। নীতিগত সংস্কার প্রস্তাবনা নেই। এমনকি জনস্বার্থ ইস্যুতেও সে কোনো অংশীজন নয়। এটাই জাতীয় পার্টির শূন্যতা। জনসমর্থন যে দিন দিন শূন্যের দিকে দ্রুত ধাবমান, সেদিকে নেতাদের মনোযোগও নেই ক্ষমতার ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে কোন্দলে মত্ত থাকায়। দলটাকে দেখলে মনে হয় যেন ধীরগতিতে বিলুপ্তির পথে চলেছে। রংপুরকেন্দ্রিক একটা ক্ষয়িষ্ণু আঞ্চলিক দলে পরিণত হচ্ছে এটি। প্রশ্ন হলো, রওশনের নতুন ব্র্যাকেট কতটা এগোতে পারবে, যখন খোদ জাতীয় পার্টিরই ভবিষ্যৎ এখন শঙ্কায়?

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারায়ণগঞ্জে অপহরণকারী চক্রের ৪ সদস্য গ্রেপ্তার

আ.লীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি বন্ধুর ছুরিকাঘাতে খুন

রাবির হলে দুপক্ষের সংঘর্ষ, ছাত্রলীগের ৪ নেতা বহিষ্কার 

ধামরাইয়ে নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করে তালা দিলেন আ.লীগ নেতা

শিক্ষকতার চাকরি খুঁজছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাইফুল

নরসিংদীতে বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা-অগ্নিসংযোগ, টেঁটাবিদ্ধসহ আহত ২০

ঝালকাঠিতে পথসভায় হামলা, চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ আহত ২০

পরিত্যক্ত সবজি থেকে পলিথিন, কলাগাছের তন্তু থেকে প্লাস্টিক তৈরি

ঢাকায় প্রথম দিনে ব্যস্ত সময় কাটালেন ডোনাল্ড লু

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে’

১০

পথচারীদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সোনালু ফুল

১১

প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে পোস্ট, অতঃপর...

১২

চবি আইইআর ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি কাওসার, সম্পাদক মিমি

১৩

চাল বিতরণে অনিয়ম, ইউপি সদস্য বরখাস্ত 

১৪

কয়রার বাগালী ইউনিয়ন পরিষদের উন্মুক্ত বাজেট সভা

১৫

ভিডিও দেখে আঙ্গুর চাষে সফল আনোয়ার

১৬

ব্যাংক ১ টাকা দিয়ে ১০ টাকার জমি নিতে চায় : রাফসান

১৭

অনিয়মের বেড়াজালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

১৮

তুরস্কে চিকিৎসা নিচ্ছে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা: এরদোয়ান

১৯

গতিসীমার মধ্যে থেকেও ওভারটেকিংয়ের পথ দেখালেন ডিএমপি কমিশনার

২০
X