জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটারের বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে ৩০০টি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে। দেশের উত্তরপ্রান্ত থেকে ভৌগোলিক ধারাবাহিকতায় ১৯০ নম্বর নির্বাচনী এলাকাটি ঢাকা-১৭ নামে পরিচিত। উত্তরে মানিকদী থেকে দক্ষিণে সেনানিবাস এবং পূর্বে বারিধারা- গুলশান থেকে পশ্চিমে মিরপুরের অংশবিশেষ নিয়ে বর্তমানের ঢাকা-১৭ নির্বাচনী এলাকা। যে কোনো বিচারে এ নির্বাচনী এলাকাটি অনন্য ও অসাধারণ। এই এলাকায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও বিদেশি রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারসহ বহু দাতা সংস্থার অফিস ও কর্মকর্তাদের বাসস্থান। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ অন্যান্য নানা সরকারি অফিসসমৃদ্ধ এলাকা ঢাকা-১৭। সব বাহিনীপ্রধানও এই এলাকায় বসবাস করেন। একদিকে দেশের শীর্ষ ধনী সম্প্রদায় আবার অন্যদিকে নিম্ন আয়ের চালচুলাহীন বস্তিবাসীও এই এলাকার ভোটার। ঢাকার এই এলাকায় ছোট-বড় ১৫টি বস্তিতে প্রকৃত ভোটার কতজন, এ প্রশ্নের জবাব কারও কাছে আছে বলে মনে হয় না। চাকরিজীবী বা মধ্যবিত্তের ব্যাপক বসবাস এই এলাকার আরেক বৈশিষ্ট্য। ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাসে যৌক্তিক খরচে মানসম্মত একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তুলনামূলক ভালো নিরাপত্তাব্যবস্থা এই এলাকাটিকে মধ্যবিত্তদের পছন্দের আবাসিক এলাকায় পরিণত করেছে। এই এলাকায় আরও রয়েছে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাজার হাজার পরিবার।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই এলাকা বিশেষ তাৎপর্যময়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে ঢাকা সেনানিবাসের একটি দালানে বন্দি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমানে সেখানে একটি স্মৃতি জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই এলাকা ঢাকা-৯ আসন রূপে দক্ষিণে তেজগাঁও থেকে উত্তরে টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং এ আসন থেকে নির্বাচন করেন ও তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আমেনা বেগম থেকে প্রায় ছয়গুণ বেশি ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও তেজগাঁও থানার একাংশ নিয়ে ঢাকা-১৪ আসন বিস্তৃত ছিল। বর্তমান ঢাকা-১৭ অঞ্চলও এ আসনের অন্তর্গত ছিল। তিয়াত্তরের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ড. কামাল হোসেনও নিকটতম প্রার্থী তৎকালীন জাসদের শাজাহান সিরাজ থেকে প্রায় ছয়গুণ বেশি ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। পঁচাত্তরে পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৯ সালে বিএনপির ডাক্তার আবদুর রউফ এবং ১৯৮৬ সালে তৎকালীন জাতীয় পার্টির রহমতুল্লাহ এই এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন। দেশের একটি রাজনৈতিক পক্ষ প্রায়ই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টির জন্মস্থান হিসেবে ঢাকা সেনানিবাস তথা বর্তমান ঢাকা-১৭ এলাকাকে চিহ্নিত করে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জেনারেল জিয়া এবং জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জেনারেল এরশাদ এ সেনানিবাসে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন এবং সপরিবারে বসবাস করেছেন। খালেদা জিয়াও দীর্ঘদিন এখানে তার দুই সন্তান তারেক ও কোকোকে বড় করেছেন। হয়তো সেই টানেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে যে পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে খালেদা জিয়া জয়লাভ করেন, তার একটি ছিল তৎকালীন ঢাকা-৫, যা বর্তমানে ঢাকা-১৭। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া এ আসন ছেড়ে দিলে আরেক সামরিক আমলা মেজর কামরুল উপনির্বাচনের মাধ্যমে এ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া এ কে এম রহমাতুল্লাহ নির্বাচিত হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপির মেজর কামরুলের কাছে হেরে যান। ২০০৮ সালের সালে দৃশ্যপটে আসেন জেনারেল এরশাদ। সেনানিবাস ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ভোটকেন্দ্রে অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এ নির্বাচনে। এসব কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকে ব্যাপক ভোট সার্বিকভাবে এরশাদকে বিজয়ী করে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে এই এলাকার মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পায় টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে নতুন দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) মাঠে নেমেছে। এই দলটি কি কিংস পার্টি, না বিএনপির বি-টিম, না বিএনপি ভাঙার চেষ্টা—এমন বিতর্ক চলতে চলতে নির্বাচন হয়ে গেল এবং দেখা গেল, এই এলাকার অর্থাৎ বর্তমান ঢাকা-১৭-এর এমপি হয়েছেন বিএনএফ প্রধান এসএম আবুল কালাম আজাদ। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ফিল্মি কায়দায় আজাদকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে এমপি হন সদ্য প্রয়াত আকবর হোসেন পাঠান তথা বাংলা সিনেমার এককালের জনপ্রিয় নায়ক ফারুক। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গত ১৫ মে তার মৃত্যু হলে ঢাকা-১৭ আসনটি শূন্য হয় এবং আসছে ১৭ জুলাই এ আসনে উপনির্বাচনের আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়।
এমন সিদ্ধান্তের আলোকে বর্তমানে চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রচারণা, দোষারোপের প্রতিযোগিতা, বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদি। যথাসময়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে ১৭ তারিখের নির্বাচিত ঢাকা-১৭ আসনের নবনির্বাচিত এমপি শপথ গ্রহণের পর সম্ভবত ১১৭ দিন এমপি হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবেন। আর এই ১১৭ দিনের এমপি হতে আওয়ামী লীগ থেকেই আগ্রহ প্রকাশ ও জোট তদবির করেন ১৭ জনেরও বেশি (জানামতে ২২ জন) আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। শেষ বিচারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তার আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আলী আরাফাতের হাতে নৌকার বৈঠা তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। এ নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত গুলশান ও বনানী এলাকার অভিজাত, বিশাল ও আলিশান অট্টালিকাগুলোর মধ্যেই গুলশান লেক এবং লেকের মাঝের দ্বীপে বিশাল কড়াইল বস্তি। এ বস্তিতে যেতে এখনো নৌকার প্রয়োজন হয়। আরাফাতের মতো বিদেশে লেখাপড়া করা অভিজাত মানুষ নৌকার বৈঠা বেয়ে এ বস্তিতে পৌঁছতে পারলেও বস্তিবাসীর মনে কতটুকু পৌঁছতে পারবেন, তার ওপরই নৌকার সাফল্য নির্ভর করবে। এ দেশের মানুষের কাছে প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট ও মুসলিম জাহানের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং জেনারেল জিয়া ও খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পর আরাফাত নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন এই আওয়ামী লীগ প্রার্থী। একজন উচ্চশিক্ষিত, অপেক্ষাকৃত তরুণ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার মনোনয়ন গ্রহণ যোগ্যতা পেয়েছে। নির্বাচনের মাঠে বিএনপি বা বড় কোনো রাজনৈতিক শক্তির তৎপরতা না থাকায় পরবর্তী ১১৭ দিনের এমপি হিসেবে এম এ আরাফাত জয়ী হবেন বলেই অনেকে আশা করছেন। তবে এই আরাফাতকে (এ) রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন আরেক ‘এ’, তথা আলম, যিনি হিরো আলম হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এ বনাম এ-এর এই লড়াইয়ে কে জিতবেন, তা নিয়ে ব্যাপক হাস্যরস আর গল্পগুজব চলছে নির্বাচনী এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমান ঢাকা-১৭-এর প্রাক্তন এমপিদের অধিকাংশের স্থায়ী নিবাস এই এলাকার বাইরে। যেমন বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ (ধানমন্ডি), ড. কামাল হোসেন বরিশাল (ধানমন্ডি), বেগম জিয়া ফেনী, এরশাদ রংপুর এবং আবুল কালাম আজাদ সবুজবাগ (ঢাকা) এলাকার কৃতী সন্তান হিসেবে পরিচিত। বতর্মান আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম এ আরাফাত রাজশাহীর মানুষ। আর হিরো আলাম তো ‘বগুড়ার বীর’ নামে অধিক পরিচিত। এ দুইয়ের মধ্যে মূল লড়াই হবে বলে ভাবছে এলাকার জনগণ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এই এলাকার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার সালেক মোল্লার মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ১২ জুন ২০২৩ তারিখে কাউন্সিলর নির্বাচন হয়। সেই কাউন্সিলর নির্বাচনের আগে প্রচার-প্রচারণা, মিছিল ও গণসংযোগের যে ব্যাপকতা ছিল, তার কিয়দংশও পরিলক্ষিত হচ্ছে না এ নির্বাচনে। দলীয় বিচারে আরাফাত এগিয়ে থাকলেও, এ দেশের শিক্ষিত ও অভিজাত মানুষের মধ্যে রাজনীতি ও ভোটের প্রতি অনীহা অনেকটা শঙ্কার কারণ। এ দেশে ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় ড. কামাল হোসেনের মতো সংবিধান প্রণেতা ও আন্তর্জাতিক মানের আইনজীবী নির্বাচনে হেরে জামানত হারান। এই ধানমন্ডি ও লালবাগ এলাকায় ২০১৪ সালে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস একক প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। ২০২০ সালে তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী হিসেবে পদত্যাগ করেন। পরে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে এ আসনে নির্বাচন করেন বিজিএমইএর নেতা মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। এ নির্বাচনে ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৫ জন ভোটারের মধ্যে ১৫ হাজার ৯৫৫ জন (৪.৯৭) শতাংশ তাকে ভোট দেন এবং তাতেই তিনি নির্বাচিত হন এবং সংসদ সদস্য হন। উল্লেখ্য, এই ধানমন্ডি ও লালবাগ এলাকাতেও শিক্ষিত ও অভিজাত মানুষের ছড়াছড়ি। ঢাকা-১৭ আসনের আসন্ন নির্বাচনে আরাফাতের তথা নৌকার মূল চ্যালেঞ্জ এ শিক্ষিত ও অভিজাতদের কেন্দ্রে নেওয়া এবং ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করা। পক্ষান্তরে ১৫টি বস্তিতে নিজ প্রতীক একতারার ভালোই সুর তুলেছেন হিরো আলম। ফলে বস্তিবাসীরা দলে দলে তাকে ভোট দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আবার আওয়ামীবিরোধীদের সামনে হিরো আলম ছাড়া তেমন পছন্দ কেউ নেই বললেই চলে। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ আসনের অপরাপর প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টির (বিদিশা) মনোনীত মেজর শিকদার আনিস (অব.) গৌরনদী, বরিশাল; তৃণমূল বিএনপির মেজর ডা. শেখ হাবিবুর রহমান (অব.) দীঘলিয়া, খুলনা; সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আক্তার হোসেন পুরান ঢাকা ও গণতন্ত্রী পার্টির অশোকধর ফেনী এলাকার সন্তান।
প্রিয় পাঠক, এ লেখা প্রকাশের অল্প কদিনের মধ্যেই হয়তো প্রকাশ পাবে ঢাকা আসনের নবনির্বাচিত এমপির নাম। আগেই বলেছি, এ আসনে আগে নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, জেনারেল জিয়া, কালেদা জিয়া, ডক্টর কামাল হোসেন ও জেনারেল এরশাদ। তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বগর্বে সংসদে প্রবেশ করবেন নতুন এমপি। আসন্ন সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনায় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার উষ্ণ সংবর্ধনা জানাবেন এই এলাকার নবনির্বাচিত এমপিকে। এখন সব প্রার্থীর মধ্য থেকে যে কোনো দুজনকে বাছাই করুন এবং যে কোনো একজনকে বঙ্গবন্ধু, খালেদা জিয়া, জেনারেল এরশাদ বা ড. কামাল হোসেনের পদাঙ্ক অনুসরণকারী কল্পনা করুন। কী দেখলেন কল্পনায়? এ নির্বাচনে বস্তুত কেউ হারবেন না। একজন বেশি ভোট পেয়ে জিতবেন। আর যাকে হারিয়ে তিনি জিতবেন, তার নামও অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবে। হয়তো সঠিক রাজনীতির কারণে, নয়তো রাজনীতিকে পচানোর কারণে।
শেষ করব প্রাচীন গ্রিসের ধ্রুপদি যুগের দার্শনিক প্লেটোকে স্মরণ করে। তার অনেক উদ্ধৃতি প্রেম, রাজনীতি, ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের বিষয়গুলোকে আজও জীবন্ত করে রেখেছে। প্লেটো বলেছেন, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করার একটি শাস্তি হলো যে তুমি নিকৃষ্ট লোকদের দ্বারা শাসিত হবে। তোমার যদি নিজের সরকারের বিষয়ে আগ্রহ না থাকে, তাহলে তুমি বোকাদের শাসনের অধীনে জীবনযাপন করবে।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
email : [email protected]
মন্তব্য করুন