যুক্তরাষ্ট্র চাইলে সবই হয়, এটা সবাই মানে—তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চার দিনের সফর শেষ করেছেন দেশটির হাইপ্রোফাইলরা। যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুসহ প্রতিনিধিদলটির সফরে রাজনীতি-কূটনীতিতে অবুঝরাও দেখল, যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া-পাওয়ার কত দাম! তারা চায় বলে আগামী নির্বাচন নিয়ে সংলাপ হবে। সরকারই উদ্যোগ নেবে। বিএনপিও যাবে সেই সংলাপে। সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনও হবে। কেন? যুক্তরাষ্ট্র চায় বলে। তারা বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা দেখতে চেয়েছে। তা দেখাতে দেরি করেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতাহীন বিরোধী দল বিএনপি। দু’দল একই দিনে একই সময়ে মাইলখানেক দূরত্বের মধ্যে ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করেছে। দুই সমাবেশের লেজে-লেজে লেগেছে। কোথাও একটি পটকাও ফোটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া-পাওয়া বলে কথা। সাধারণ জনগণসহ বিভিন্ন মহল মাথা ঠুকে দুদলের কাছে একটু রহম চেয়ে আসছে। বলে আসছে পাণ্ডামি কমাতে। একটু রয়েসয়ে চলতে। তাদের এ চাওয়া-পাওয়া সামান্যতম গ্রাহ্য হয়নি দুদলের কারও কাছেই। অথচ যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি চাওয়া লাগেনি। ধমক বা চাপও দেয়নি। শুধু একটু অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল মাত্র।
বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র কখনো বল সোজা ছোড়ে না। তারা চাক্কি ছোড়ে। বুঝেশুনে ব্যাট চালালে সেখানে ছক্কা মেলে। নইলে অক্কা। যুক্তরাষ্ট্রের চাক্কি বা গুগলিতে বাম ঘরানার কয়েকটি দল ছাড়া রাজনীতির প্রায় সব পক্ষই খুশি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে খুশি-মহাখুশির ধুম প্রতিযোগিতা। তাদের দফাও এক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগেরও এক দফা, বিএনপিরও এক দফা। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন। কে কার কাছে কীভাবে চায়—এটুকু বাদে সব ল্যাটা যেন মিটে গেছে। সরকারি দল বেদম ফুরফুরা। বিএনপি যারপরনাই ঝরঝরা। রীতিমতো আচানক ম্যাজিক। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জেয়ার টুইট হচ্ছে—‘বাংলাদেশি জনগণের জন্য একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নোঙর করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করছি।’ তার বা তাদের প্রত্যাশা বলে কথা। তারা ধমকালেও সুখ পাওয়ার মহল এ দেশে আছে। মার্কিনি ধমক বলে কথা। তা যার-তার ভাগ্যে থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের ধমক শুনতেও যোগ্যতা লাগে। সেখানে ধমক বা হুমকির বদলে মিলেছে শুধু প্রশংসা। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে আজরা জেয়ার বক্তব্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রেস রিলিজ আকারে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। যার রেফারেন্স জেয়ার টুইটেও দেওয়া হয় : ...‘ধন্যবাদ, পররাষ্ট্র সচিব মোমেন, আপনার আতিথেয়তার জন্য। আমি আজকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দেখা করতে পেরে আনন্দিত হয়েছি । গত পাঁচ দশকে আমাদের দুই দেশের চমৎকার অংশীদারত্ব গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র আগামী ৫০ বছর এবং তার পরেও বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা আরও গভীর করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে...।’
অনুভূতির এমন মান ও ভাষার প্রশংসার পর কি বিশ্বাস হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের সরকারের সামান্যতম মনোমালিন্য আছে? স্যাংশন দেওয়া, ভিসা নীতি ঘোষণা বা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ২০ ঘণ্টা জার্নি করে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া নিরর্থক ধরনের কোনো কথা আদৌ হয়েছে? এরপরও জেয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব অনেক কমেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আগামী ৫০ বছর এবং তার পরও বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের ভালোবাসা আরও গভীর করতে উতলা হয়ে আছে, সেখানে ‘দূরত্ব’ শব্দটিই অবান্তর। তারপরও বুঝি দু-চার কথা বলতেই হয়! ব্রিফিংয়ে সালমান এফ রহমান ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন, র্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে, তা অনেক কমে এসেছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, দুই দেশের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি নিশ্চয়ই আছে। যদি এটা না থাকত তাহলে নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতি এগুলো হতো না। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রেস রিলিজ আকারে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা জেয়ার বক্তব্যে বলা আছে, ‘সাংবাদিকদের প্রতিশোধ বা ভয়ভীতি ছাড়াই সংবাদ প্রতিবেদন করার ক্ষমতা; ব্যক্তি পাচার প্রতিরোধে সহযোগিতা এবং নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা মানবাধিকার এবং শ্রম অধিকার ও মতপ্রকাশ এবং সমিতির স্বাধীনতাসহ মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান করে। তার মানে সব ঠিকই আছে। সব ঠিক থাকলে আবার ডিমান্ডের চাক্কি ছুড়ছেন কেন? তারা সহিংসতামুক্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখতে চান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী দেখতে চান, মৌলিক মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা চান কেন?
এটাই মার্কিন কূটনীতির ধরন বা বৈশিষ্ট্য। তারা সবাইকেই সুখ দেয়। উইন-উইন ভাবতে অভ্যস্ত রাখে। আরও অনেক দেশের সমস্যা সমাধানের দাওয়াই তাদের হাতে। সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। তাদের কাছে বাংলাদেশের নালিশ দুপক্ষেরই। সেইসঙ্গে দফাকাণ্ড। তাও মাত্র এক দফা। বিএনপির এক দফা : এই সরকারকে চলে যেতে হবে, নির্বাচন দিতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। আবার ক্ষমতাসীনদেরও মাত্র এক দফা : শেখ হাসিনার আমলের নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনেই হবে।
দফা বিষয়ে এটি অভিনবত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি নতুন ঘটনা। দফা বা দাবি পেশ করা হয় কর্তৃপক্ষ বা অথরিটির কাছে। সরকারি দল কার কাছে এক দফা উত্থাপন করল রীতিমতো দুর্বোধ্য। গণতন্ত্রের প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং পশ্চিমা গণতন্ত্রের পতাকাবাহী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এমন কাণ্ড সাম্প্রতিককালে মোটা দাগের ঘটনা হয়ে রইল। যার বিশ্লেষণ এখনই শেষ হওয়ার মতো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশস্থ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত কিছুদিন আগে বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশে থেকে ফোর্স প্রেরণের ব্যাপারে ‘মানবধিকার ভঙ্গ করা হচ্ছে না’ বলে প্রত্যয়নপত্র দাখিল করা এবং গণতন্ত্র প্রক্রিয়া বিনষ্টকারী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে নতুন ভিসা নীতি প্রণয়নের বিষয় উপেক্ষা করে সরকারি দলের এক দফা বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিয়ে আলোচনার নতুন দুয়ার খুলেছে।
বাংলাদেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। আগামী নির্বাচনও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার দাবিতে বাংলাদেশের প্রায় সব বিরোধী দল জোট বেঁধেছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত পশ্চিমা বিশ্বের গণতন্ত্রের প্রবক্তারা কোনদিকে ঝোঁকেন তা দেখার অপেক্ষা নানা মহলে। ‘আমরা কোনো একটি দলের পক্ষে নই’ জানান দিয়ে প্রশ্নের গভীরতা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উভয়পক্ষের দাবি বা নালিশ সফররত বিদেশিদের কাছেই। একইদিনে ঢাকায় বিশাল শোডাউন করে তারা একটি নজির তৈরি করেছে। যার টার্গেট যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং ইউএসএআইডির এশিয়া ব্যুরোর উপসহকারী অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলী কর বাংলাদেশে সফরের আগে ভারত হয়ে আসছেন নাকি সরাসরি ওয়াশিংটন থেকে ঢাকায় আসছেন, তা নিয়ে প্রশ্নের অন্ত ছিল না। ভারতের মাটিতে ‘দ্য হিন্দুস্তান টাইমস’ পত্রিকায় আজরা জেয়া সাক্ষাৎকারে “এ অঞ্চলজুড়ে দেশগুলোর কাছে ‘ইতিবাচক বিকল্প’ প্রস্তাব করার জন্য কীভাবে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করতে পারে” সে সম্পর্কে কথা বলেছেন। এ অঞ্চলের দেশগুলোর কাছে একটি ‘ইতিবাচক বিকল্প’ প্রস্তাব করার জন্য কীভাবে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করতে পারে সে সম্পর্কে কথা বলেছেন যাতে তারা এ সময়ে তাদের সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করতে পারে যখন ‘চীনের অভ্যন্তরে ভিন্নমত দমন এবং এই মডেল বাইরের দেশে রপ্তানির প্রচেষ্টা’ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
সমাবেশে এক দফা ঘোষণার এক দিন পর সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি মহাসচিবের ‘পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না মর্মে ৩১ দফা বাড়তি কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি করেছে। কেন তার এ সময়ে জানানো জরুরি হয়ে গেল—প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছার কথাও জানানো হয়েছে। নালিশস্থল এবং উভয়ের মুরুব্বি এক মোহনায় মিলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির গতিধারা দ্রুত বদলে যাওয়ার নমুনা রাজনীতি কম বোঝা মানুষও আঁচ করছে।
লেখক : কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন