ইসলামী ক্যালেন্ডারে শুরু হয়েছে হিজরি ১৪৪৫ বর্ষ। একটি বর্ষের প্রস্থান ও আরেকটি নববর্ষের নবযাত্রা। এর মাধ্যমে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল একটি বছর—বহু দিন, ঘণ্টা, সেকেন্ড। এর মাধ্যমে অনেক শিশু পা রাখল কৈশোরের ঘরে, অনেক কিশোর পা রাখল তারুণ্যের পাটাতনে, অনেকে যৌবনের পড়ন্তবেলায় এবং অনেক মানুষ বার্ধক্যের মিছিল শেষ করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পরকালের অন্তিমযাত্রার প্ল্যাটফর্মে। মানুষের জীবন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে প্রতিমুহূর্তেই অনন্তের পথে ধাবমান। একটি বছরের বিদায় ও আগমন আমাদের সামনে সময়ের চলমানতার এ শিক্ষাই দিয়ে যায়। মানুষের জীবন আসলে সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন—দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় বছরের মাসসমূহ ১২টি; যেদিন আসমান-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে সেদিন থেকে।’ (সুরা তওবা : ৩৬)। পবিত্র কোরআনে আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনিই সূর্যকে দীপ্তিময় ও চাঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।’ (সুরা ইউনুস : ৫)। মানুষজাতি নিজেদের প্রয়োজনেই পৃথিবীতে বর্ষগণনা পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছে। ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আ.)-এর সময় থেকেই পৃথিবীতে বর্ষগণনা চলমান। সর্বপ্রথম বর্ষপঞ্জি গণনা শুরু হয় হজরত আদম (আ.)-কে আল্লাহতায়ালা জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময়কে ভিত্তি করে। পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা কেন্দ্র করে বর্ষপঞ্জির ধারাবাহিকতার ইতিহাস পাওয়া যায়। যেমন—হজরত নুহ (আ.)-এর মহাপ্লাবন, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অভিশপ্ত নমরুদ কর্তৃক অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা, হজরত ইউসুফ (আ.) মিশরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হওয়া, মুসা (আ.) তদানীন্তন মিশরের শাসক ফেরাউনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বনি ইসরাইলের বহুধা-বিভক্ত সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মিশর ত্যাগ করা, হজরত ইসা (আ.)-এর জন্ম ইত্যাদি কেন্দ্র করেই মূলত সমসাময়িকভাবে বর্ষপঞ্জি তারিখ গণনার সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সময়ে আরবের গোত্রগুলো নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্ষগণনা শুরু করে। বাসুস যুদ্ধ যা বকর বিন ওয়ায়েল ও বনি জুহাল গোত্রের মধ্যে একটা উটকে কেন্দ্র করে ৪০ বছর ধরে চলমান ছিল। ওই যুদ্ধকে মূল ভিত্তি বানিয়ে বর্ষগণনার সূত্রপাত হয় আরবে। এরপর দাইস যুদ্ধ ও আসহাবে ফিল তথা হস্তীবাহিনীর ঘটনা কেন্দ্র করে বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করা হয়। (উমদাতুল কারি : ১৭/৬৬)। এ ছাড়া প্রাচীন পারস্যে ছিল খসরু বর্ষ, ব্যাবিলনে ছিল সম্রাট বুখতে নসরের জন্ম তারিখভিত্তিক বর্ষগণনা, গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং উজ্জয়িনীর কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫২ অব্দে ভারতবষের্র বিক্রমী বর্ষপঞ্জি, রোমের রোমান ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। হজরত ইসা (আ.)-এর জন্মদিন থেকে খ্রিষ্টাব্দ বা ইংরেজি সনের প্রচলন হয়। মহানবীর হিজরতের ঘটনা কেন্দ্র করে বিশ্ব মুসলিম গণনা করে হিজরি বর্ষ। হিজরি বর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম উম্মাহর সাংস্কৃতির ও ঐতিহাসিক আবেগের স্মারক বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় ও পুণ্যময় জন্মভূমি মক্কানগরী ত্যাগ করে বিরহ বেদনা নিয়ে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর আল্লাহ অস্বীকারকারীদের এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছিলেন, তখন তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষরা তার বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছিল। গোপনে গোপনে তিনি তিন বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন। এরপর আল্লাহর নির্দেশে সাফা পাহাড়ে প্রকাশ্যে এক আল্লাহর ওপর ইমান আনয়নের ঘোষণা করেছিলেন, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল নির্যাতনের ধারা। পথে-প্রান্তরে তাকে আহত, অপমানিত, লাঞ্ছিত করা হতো। অত্যন্ত ধৈর্য ও পরম সাহসিকতার সঙ্গে মহানবী (সা.) তার মিশন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। মক্কার কাফেররা একদিন সর্বশেষ নীতিনির্ধারণের উদ্দেশে তাদের ‘নদওয়া’ মন্ত্রণা গৃহে সব গোত্রপতির একটি বৈঠক আহ্বান করল। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিল, আমরা নানা কৌশল করে মুহাম্মদ (সা.)-কে ঠেকাতে চেয়েছি। কিন্তু কিছুই হলো না, বরং তার চেয়ে আমরা মুহাম্মদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিই। সবাই এ সিদ্ধান্তের ওপর তাদের সমর্থন ব্যক্ত করল এবং এই মহাঘৃণ্যতম কাজ সম্পন্ন করার জন্য সব গোত্র থেকে শক্তিশালী যুবকদের বাছাই করা হলো। ঘোষণা করা হলো, যে মুহাম্মদ (সা.)-কে জীবিত অথবা মৃত এই ‘নদওয়া’ গৃহে হাজির করতে পারবে, তাকে ১০০ উট পুরস্কার দেওয়া হবে। মক্কার সব গোত্র থেকে শক্তিশালী যুবকরা একত্রিত হয়ে শপথ নিল আজ রাতেই মুহাম্মদ (সা.)-এর বাড়ি ঘেরাও করে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো হবে। এদিকে আল্লাহতায়ালা তার রাসুলকে জানিয়ে দেন, মক্কার মানুষ আপনাকে চায় না, মদিনার মানুষ আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, মদিনায় আপনি হিজরত করে চলে যান। মহানবী (সা.) আল্লাহতায়ালার এ ঘোষণা পাওয়ার পর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আউয়াল কুবা মহল্লায় পৌঁছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন মহানবী (সা.)। এ হিজরতেরই স্মৃতিবহন করে আসছে আমাদের হিজরি বর্ষ। (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত-তারিখ : ১/৮) মুসলমানরা সাধারণত মহানবীর নবুয়তপ্রাপ্তির সময় থেকে বর্ষগণনা চালু রাখেন। এ ছাড়া আরবে প্রচলিত বর্ষগণনাও ব্যবহৃত হতো। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব ছিল না। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতকালে সব মুসলমানের ঐকমত্যে হিজরি বর্ষ রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বীকৃতি লাভ করে। ওমর (রা.)-এর সময়কালে বসরার গভর্নর আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফার কাছে এক পত্রে লেখেন, ‘হে আমিরুল মুমিনীন, আমাদের কাছে বহু পত্র আসে, যাতে তারিখ লেখা থাকে শাবান। কিন্তু তা কি বর্তমান বছরের, নাকি অতীতের—আমরা বুঝতে পারি না। তারপর ওমর (রা.) সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করুন।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন ও একটি পরামর্শ সভার আহ্বান করেন। সভায় নবীজি (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, নবুয়ত ও হিজরত—বিশেষত এ চারটি সময় থেকে বর্ষগণনার প্রস্তাব আসে। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) নবীজি (স.)-এর ইন্তেকালের বছর, তালহা (রা.) নবুয়তের বছর, আলি (রা.) হিজরতের বছর থেকে বর্ষগণনার প্রস্তাব দেন। তারপর তারা সবাই আলি (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন। কারণ নবীজির জন্ম ও নবুয়তের সন নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে আর মৃত্যু শোকের স্মারক। তাই হিজরতের ত্যাগের ঘটনার মাধ্যমেই প্রচলিত হয় সাল গণনা। (উমদাতুল কারি : ১৭/৬৬)। হিজরি সনের মাসগুলো হলো—মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত ওমর (রা.) কর্তৃক হিজরি সন প্রবর্তিত হওয়ার এক বছর পরই আরব বণিকদের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। পরে ৫৯৮ হিজরি মোতাবেক ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলার জমিনে মুসলিম শাসনের ইতিহাস সূচিত হয়। ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের মাধ্যমে জাতীয় সন গণনায় পরিণত হয়। সন গণনায় দীর্ঘ ৫৫০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর থাকার পর ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের মাধ্যমে হিজরি সনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অবসান ঘটে। বিশ্ব শান্তির দূত ও কল্যাণের প্রতীক মহানবীর ত্যাগ ও স্মৃতির স্মারক হিজরি সনের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মহররম ছুটি ঘোষণা করে জাতীয়ভাবে হিজরি নববর্ষ উদযাপনের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার মুফতি শফি উসমানী (রহ.) তার তাফসিরে মায়ারিফুল কোরআনে লিখেছেন, ‘সৌর হিসাব রাখা ও ব্যবহার করা নাজায়েজ নয়। বরং এই ইখতিয়ার থাকবে, কোনো ব্যক্তি নামাজ, রোজা, জাকাত, ইদ্দতের ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে সৌর হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু শর্ত হলো, সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের মধ্যে চন্দ্র হিসাবের প্রচলন থাকতে হবে। যাতে রমজান, হজ ইত্যাদি ইবাদতের হিসাব জানা থাকে। ইসলামী ফিকাহবিদরা চন্দ্রবর্ষের হিসাব রাখাকে মুসলমানদের জন্য ফরজে কিফায়া বলেছেন।’ (মায়ারিফুল কোরআন, সুরা তাওবা—৩৬ নম্বর আয়াতের তাফসির)। হিজরি নববর্ষে আমাদের নতুন করে জীবন সাজানোর সুযোগ দিয়েছে। অতীতের পাপ ও জরা ভুলে আমলের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতে পারি নতুন বছর। পৃথিবীর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
মন্তব্য করুন