আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপনাকালে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, বিভাগের চেয়ারম্যান, সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসের পরিচালক প্রভৃতি পদে দায়িত্ব পালন করে অবসরে যাওয়ার প্রাক্কালে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করি। ৩০ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের সময় করোনার মধ্যেই প্রচুরসংখ্যক ফুলের তোড়া নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাকে আগমনী অভিনন্দন জানান। আমি সে সময় তাদের বলেছিলাম, এখন ফুলগুলো আমি রাখলাম। তবে অন্তর থেকে গ্রহণ করব যদি মেয়াদ শেষে আমার চলে যাওয়ার সময় এভাবে এগুলো আপনারা আমার হাতে তুলে দেন এবং আমিও এমন যোগ্যতা ও পরিবেশ বজায় রেখে বিদায় নিতে পারি। সে সময়ে যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, ফুল দিতে আসতেন, তারা প্রায় প্রত্যেকে আমাকে একটি কথা বলতেন—স্যার, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে কোনো উপাচার্য মেয়াদ পূরণ করে কিংবা প্রকৃতপক্ষে সেভাবে মানসম্মান নিয়ে যেতে পারেননি।
আমার মেয়াদকালের প্রথম দিকে করোনা, পরবর্তীকালে কখনো কখনো জাতীয়-আন্তর্জাতিক কারণে রাজনীতি-অর্থনীতির মেঘলা আকাশ, জাতীয় নির্বাচন প্রভৃতি থাকলেও এ পর্যন্ত এক দিনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, পরীক্ষা কিংবা গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ থাকেনি—এটি আমার একটি বড় তৃপ্তির জায়গা। তবে হ্যাঁ, এক-দেড় বছর ধরে আমার বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্য, দুর্নীতি, নিয়ম ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থ নয়-ছয় করা—এমন এন্তার অভিযোগ উত্থাপন করে ব্যাপকভাবে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই একটি অধ্যায়ে এসে একটি পত্রিকা সর্বশেষ ৪ মে তারিখে ‘৫৩৭ কোটি টাকা মেগা প্রকল্প ঝুঁকিতে’ শিরোনামে উপাচার্যের একাধিক দুর্নীতি আর অনিয়মের ফিরিস্তি দিয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন সময়ে আরও দু-চারটি মিডিয়া, অনলাইন পত্রিকাও এমন খবর প্রকাশ করেছে।
আমার বিরুদ্ধে প্রায় এক-দেড় বছর আগে থেকে মিথ্যাচার করে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় খবর প্রকাশ শুরু হয়। আমার স্ত্রীর নামে একটি ফেক আইডি খুলে সেখানে কে বা কারা আমি দুর্নীতি করছি—এমন গল্প বানিয়ে মনের মতো করে উদ্দেশ্যমূলক লেখালেখি দিয়ে সেসব লেখার স্ক্রিনশট নিয়ে প্রথমে অনলাইনে, অতঃপর বিভিন্ন সময়ে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের কিছু স্থানীয় পত্রিকা ও ঢাকার কিছু পত্রিকায় তা ছাপিয়ে সেগুলো একত্র করে ৩০-৪০ পৃষ্ঠার বান্ডিল বানিয়ে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, দুদক, কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি এমন সব জায়গায় তা প্রেরণ করা শুরু করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অদৃশ্য নিকষকালো ছায়া শক্তি রয়েছে, যারা উপাচার্য বা তাদের বিবেচনামতো প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা এমনকি শিক্ষক বা শিক্ষার্থীকেও পর্যন্ত টার্গেট করে তাদের ব্যক্তিগত কথোপকথন ধরে সেগুলো খণ্ডিত ও বিকৃত করে, আবার কখনোবা সুপার এডিট করে এর অংশ বিশেষ নিয়ে অডিও-ভিডিও বানিয়ে একজনকে সম্মানহানি ও বিপদে ফেলে স্বার্থ হাসিল করতে চায়। শুনেছি আমার ক্ষেত্রেও তারা নাকি এক ডজন অডিও বানিয়ে এভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক সময় এমন অডিও ভ্যানে করে মাইকযোগে জনসম্মুখে প্রচারমাধ্যমে উপাচার্যের মান-মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। আমার ক্ষেত্রেও কখনো কখনো এমনটি করা হয়েছে।
আমি গত বছর হজব্রত পালনের জন্য কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে মক্কায় অবস্থানকালে আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ছবি পাই। পরে জানতে পারি এটি কে বা কারা বিভিন্ন জায়গায় এবং গ্রুপে পাঠিয়েছে। বিষয়টি ছিল ৫০০ টাকার নোটের মতো করে জাতির পিতার ছবির স্থলে আমার ছবি ব্যবহার করে একটি ৫০০ টাকার নোট বানিয়ে তা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিয়ে এমনভাবে প্রোপাগান্ডা করা হয়েছে যে, আমি যেন ঈদে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করছি এবং মানুষকে টাকা বিলিয়ে বেড়াচ্ছি।
আমি জানি না সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে আমার দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত এ খবরটি এ ধরনের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা কি না? এ খবরটিতে বেশ কিছু অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ কাল্পনিকভাবে দাঁড় করানো হয়েছে; যার প্রত্যেকটি মিথ্যা, বস্তুনিষ্ঠহীন এবং মুখরোচকতায় ভরা। আমি আমার এ লেখায় সেসব অভিযোগের জবাব দিতে চাই।
প্রথমত, পত্রিকাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমি বিভিন্ন সময় নিয়োগবাণিজ্য করেছি। নিয়োগের জন্য চেক চেয়ে নিয়েছি, আমার কণ্ঠ বা কণ্ঠসাদৃশ্য এমনসব অভিযোগ সংবলিত অডিও রয়েছে। আমি সম্পূর্ণভাবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি। এসব অডিওর সব বানোয়াট, মিথ্যা, একপক্ষীয় বা খণ্ডিত (অন্যপ্রান্তে কে/কী বলছেন তা অনুপস্থিত) এবং হয়তোবা সুপার এডিটেড। অডিওর সত্যতা যাচাই এবং এর ভিত্তিতে আমি কার কাছ থেকে কবে টাকাপয়সা বা কী সুবিধা গ্রহণ করেছি অথবা দুর্নীতি করে ব্যক্তি হিসেবে কীভাবে লাভবান হয়েছি, কে আমাকে টাকাপয়সা দিয়েছে—তন্ন তন্ন করে তা দেখার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আমি উদাত্ত আহ্বান রাখছি।
কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ৯টি ভবনের পাইলিং কমিয়ে দিয়ে সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছি। সেখান থেকে ৬ কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেছি। বস্তুনিষ্ঠহীনভাবে এ ধরনের খবর পরিবেশন শুধু দুঃখজনকই নয়, সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিমালারও চরম বিচ্যুতি। ঢালাওভাবে এ ধরনের খবর প্রকাশের আগে অভিযুক্তের মতামত এবং ফাইলপত্র চেক করে নেওয়াই উত্তম। যে কোনো নির্মাণে পাইলিংয়ের জন্য মাটির নিচে রড কতটুকু যাবে তা নির্ভর করে সয়েল টেস্টের ওপর। আমি উপাচার্য হিসেবে যোগদানের বহু আগেই প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সয়েল টেস্ট করে প্রকল্প দলিল প্রণীত ও অনুমোদিত হয়েছিল। আমার সময়ে এসে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর যখন পাইলিং শুরু হয়, তখন একটি সূত্র থেকে আমি খবর পাই যে, প্রকল্প দলিল অনুযায়ী মাটির নিচে যে পর্যন্ত রড প্রবেশ করানোর কথা (ধরা যাক ৫০ ফিট) তার চেয়ে কম গভীরতায় রড প্রবেশ করিয়ে পাইলিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই প্রধান প্রকৌশলীকে বিষয়টি দেখতে বলি এবং ভিজিলেন্স টিম পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলি। ভিজিলেন্স টিমের সদস্য ও প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তারা আমাকে এসে রিপোর্ট করেন যে, সয়েল টেস্টিংয়ের ভিত্তিতে যেভাবে পাইলিংয়ের রড মাটির নিচে প্রবেশ করানোর কথা, বাস্তবে তা করা যাচ্ছে না, রড যাচ্ছে তার কম (কমবেশি ৪০ ফুট)। এ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনরায় সয়েল টেস্ট ও ভেটিং করিয়ে টেস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই গভীরতায় রড প্রবেশ করিয়ে পাইলিংয়ের কাজ করানো হয়েছে। বিষয়টি প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, আইএমইডি, ইউজিসির প্রতিনিধিরা থাকেন) সভায় অবহিত করা হয়েছে। এখানে কীভাবে উপাচার্য মাটির নিচে রড কম প্রবেশ করিয়ে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বা অনিয়ম করেছেন, সে বিবেচনার ভার পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমি জানি না উপাচার্য হিসেবে আমার বিরুদ্ধে আর কী কী অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলো কীসের ভিত্তিতে করা হয়েছে। অভিযোগগুলো কারা করেছে তাও আমার জানা নেই। যাহোক, একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রচার-প্রোপাগান্ডার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ইউজিসিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করিয়েছে। কমিটির সদস্যবৃন্দ আমাকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে লিখিত মতামত/বক্তব্য দিতে বলেছিলেন। আমি তাদের কাছে ডকুমেন্টসহ আমার লিখিত জবাব প্রেরণ করেছি।
আশা করি, পাঠকবৃন্দ বিষয়গুলো অবহিত হয়ে একজন উপাচার্যকে কীভাবে শুধু মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত এবং বস্তুনিষ্ঠহীনভাবে অভিযোগ তুলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে—তা উপলব্দি করতে সক্ষম হবেন। উপাচার্য বা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমি শুধু এতটুকুই বলব যে, আমি কোনো ধরনের দুর্নীতি করে উপাচার্যের চেয়ারকে কলুষিত করিনি। ভবিষ্যতে এ ধরনের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো অধিকতর দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে এমনটি প্রত্যাশা রইল।
লেখক: উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া