সুভাষ সিংহ রায়
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৪, ০২:২৮ এএম
আপডেট : ২৬ মে ২০২৪, ০৭:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যা দেখি যা শুনি

নীড় ছোট ক্ষতি নেই

নীড় ছোট ক্ষতি নেই

অনেকে বলে থাকেন আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নেই। যারা জন্মসূত্রে আওয়ামীবিরোধী তারা তো এ-কথা বলেই; কিন্তু যারা জন্মসূত্রে আওয়ামী লীগের সমর্থক তারাও বলে থাকেন। আমি তাদের বলে থাকি, পুরোনো আওয়ামী আর নতুন আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই। কিন্তু একটি দলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে কত দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, সে বিষয়টি অনেকে খেয়াল রাখেন না। যারা সবসময় ভাবতেন রাজনীতি মানুষের জন্য, তারাই মূলত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। একটু কষ্ট করে গ্রাম-বাংলায় রাজনীতিবিদদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান আছে—‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’ (গীতিকার: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, কণ্ঠ: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গীতা দত্ত)।

এখন থেকে ৭৫ বছর আগে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন তারা মনে করতেন ‘নীড় ছোট হলেও তাদের আকাশ অনেক বড়’। তাদের বিশ্বাসে ছিল মানুষের ভালোবাসা, লক্ষ্য ছিল আপামর মানুষের জীবনমানের অগ্রগতি। নিজের ঘরবাড়ি ছোট হয়ে গেছে, তাতে ক্ষতি কী; তাদের দল তো জনগণের দল, দিনে দিনে দল তো অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি কারা করেছেন? আওয়ামী লীগ এই মাটিতে ইতিহাস করতে পেরেছে, কারণ আওয়ামী লীগ মানুষের জন্য লড়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু এখন দেশ ও দেশের বাইরে বেশকিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা শুধু নীতি কথাই বলেন; কিন্তু তাদের অধিকাংশরই জীবনে নীতির কোনো সম্পর্ক নেই। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদের ভাবখানা—দেশে আওয়ামী লীগ না থাকলে কোনো দুর্নীতি থাকত না। এ ব্যাপারে আমি একমত যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী গানের কথা ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’—এ কথায় খুব কম লোক বিশ্বাস করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তারা কীভাবে দুর্নীতি করেছে, তা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ‘আমি যেসব মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি সেসব মন্ত্রণালয়ের সমস্ত ফাইল গোয়েন্দা বিভাগগুলো তন্নতন্ন করে দেখেছে। আজ এই ফাইল, কাল ওই ফাইল, গ্রাম দেশের বাড়ির ভিটায় কোনো প্রাসাদ তৈরি করেছি কি না, সবকিছু। অফিসের কর্মচারীরাই এসে খবর দিয়ে যায়। অনেককে চিনিও না, তারাই এসে সব বলে যায়। কিন্তু কী বের করবে? আমি তো অন্যায় কিছু করিনি। নিজের জন্য বা আত্মীয়স্বজনের জন্য কিছুই করিনি। পারলে অন্যদের উপকার করার চেষ্টা করেছি, যারা আমার রক্ত সম্পর্কের কেউ না। আমার ভাইবোন আত্মীয়স্বজনরা আমার কাছে ঘেঁষেনি। ওদের মধ্যে কেউ ব্যবসাও করে না। দলের জন্য আমি তো কোনো চাঁদাও তুলিনি, আর তাই অন্যায়ভাবে কোনো কাজও আমাকে কারও জন্য করতে হয়নি। যেটা দেশের জন্য, দশের জন্য ভালো সেটাই করেছি। তাই অনেক চেষ্টা করেও আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাঁড় করাতে পারল না। এই চাঁদা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। মাসে তিন লাখ টাকা করে দশজন মন্ত্রীকে দলের জন্য চাঁদা দিতে বলা হয়েছিল। আমার নামও দেওয়া হয়েছিল তাতে। কিন্তু আমি এভাবে চাঁদা দেওয়ার পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তর্ক করেছি। রাজনীতিতে অর্থের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তাই নিজের ফর্মুলাও দিয়েছিলাম; কিন্তু সেটা গৃহীত হয়নি। যাক, আমি আর শেষ পর্যন্ত চাঁদা দিইনি। জাহাজমন্ত্রী নূরুল হকও চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন। এই অবাধ্যতা প্রেসিডেন্ট জিয়ার পছন্দ হয়নি।’ (চলমান ইতিহাস/জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৮৩-১৯৯০, প্রকাশক : ইউপিএল ২০০৯)। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সক্রিয় ও আগ্রাসী, তারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য ডান-বাম সবসময় এক ছিল। এখানে তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল—আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাসদের ভূমিকা কী ছিল তা সবারই জানা। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরও ওই দলটির ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটি নিদর্শন পাঠকদের সমীপে উপস্থাপন করছি। খুনি মোশতাক গুলিস্তানে এক জনসভা করতে উদ্যোগ নিয়েছিল, জনতা তা প্রতিরোধ করেছিল। তৎকালীন জাসদ রীতিমতো পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে খুনি মোশতাকের পক্ষ নিয়েছিল।

‘জনসভায় বোমার প্রতিবাদে জাসদের সমাবেশ ও মিছিল: ডেমোক্রেটিক লীগের জনসভায় বোমা হামলা ও হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ঢাকা নগর কমিটির উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমে জমায়েত ও একটি মৌন মিছিল বের করা হয়। সমাবেশে জাসদ নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক জনাব খালেকুজ্জামান চৌধুরী সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। জনাব খালেকুজ্জামান তার বক্তৃতায় এই বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সর্বস্তরের জনগণের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জনগণকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি তৎপর হয়ে উঠেছে। এই শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাবেশ শেষে একটি মৌন মিছিল গুলিস্তান হয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়।’

দুই. গত ২৩ মে ছিল বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরিও শান্তি পদক প্রাপ্তির ৫১তম বছর। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করার প্রেক্ষাপটে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের সামনে চলে আসে। মুসলিম বিশ্বের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহমর্মিতার নিদর্শন পাওয়া যায় চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে। এই যুদ্ধ ইসরায়েলিদের কাছে ‘ইয়াম কিপুর যুদ্ধ’ আর আরবদের কাছে ‘অক্টোবর যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া এই যুদ্ধ ১৯৭৩ সালের ‘আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ’, ‘রমজান যুদ্ধ’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামেও পরিচিত। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধ শুরু হলে আরব দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একাত্মতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ইসরায়েলি আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে। নিপীড়িত মানবতার জন্য বঙ্গবন্ধু সর্বদাই চিন্তিত থাকতেন এবং তাদের সহায়তা করতে সচেষ্ট ছিলেন বলে তিনি আরবদের ন্যায়সংগত এই যুদ্ধে আরব দেশগুলোকে সমর্থন জানান। তিনি শুধু নৈতিক সমর্থন জানিয়েই থেমে থাকেননি, সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য সেখানে সামরিক চিকিৎসক দল প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য, তখন পর্যন্ত অনেক আরব দেশ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেনি, তদুপরি মানবিক দিক বিবেচনা করে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু সাহায্য প্রেরণ করেছিলেন। তার সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল সাহসী ও সুদূরপ্রসারী।

বঙ্গবন্ধুকন্যা তার পিতার মতো বিশ্বাস করেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়।’ এই বিশ্বাসের বিশ্বাসী কতজন খুঁজে পাব।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘হেক্সাগার্ড রোভার’ উদ্ভাবক জিহাদের পাশে বিএনপি

সীমান্তে বিজিবির অভিযানে বিপুল ভারতীয় পণ্য জব্দ

যে কারণে পেছাল ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান

সিরিজ বাঁচাতে বাংলাদেশের সামনে সহজ লক্ষ্য

ইলেকট্রনিক মিডিয়া মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি তছলিম, সম্পাদক ফেরদৌস

সামাজিক অনুষ্ঠানে সাইক্লোন সেল্টার ব্যবহার করা যাবে : উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম

স্বাস্থ্যসেবায় নার্সদের ভূমিকা দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে : অতিরিক্ত সচিব সালাম

উল্টে যাওয়া ইঞ্জিন উদ্ধারে গিয়ে লাইনচ্যুত হলো রিলিফ ট্রেন

জকসু বিষয়ে সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক

জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছেলে-মেয়েরা জীবন দেয়নি : সারজিস

১০

মেসিকে না খেলানোর ব্যাখ্যা দিলেন স্কালোনি

১১

এনপিবি নিউজের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

১২

জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা শুরু

১৩

বাবা হারালেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা প্রিন্স

১৪

সেই মেজর জেনারেল কবিরের বিষয়ে যে তথ্য দিল সেনাসদর

১৫

আবাসিক হোটেলে প্রেমিকাকে ধর্ষণে মৃত্যু, গ্রেপ্তার ২

১৬

মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার দাবি জাকসুর

১৭

আবুধাবিতে বাংলাদেশের বোলিং তোপে চাপে আফগানিস্তান

১৮

বিএনপি সরকারে এলে জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করবে : শামা ওবায়েদ

১৯

সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক মিসাইল উন্মোচন করল উত্তর কোরিয়া

২০
X