বন বিভাগে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি চলছে। এ খাতের দুর্নীতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা কম। গণমাধ্যমও এ ব্যাপারে খুব একটা উচ্চকণ্ঠ নয়। কেননা এ খাতের দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট সবাই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়। বন উজাড়ের খেসারত গুনতে হয় শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে। আর এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেহেতু প্রভাবশালী দুর্নীতিপরায়ণদের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না, ফলে বনখেকোরা অবাধে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। সোমবার কালবেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন একটি সাম্রাজ্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “রাত গভীর হলেই কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দুর্গম বারবাকিয়া এলাকা থেকে সারি সারি ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায় বনের গাছ। এভাবে চলতে থাকায় প্রায় আট হাজার একর বনভূমি উজাড় হওয়ার পথে। পাহাড় কেটে মাটি ও বালু বিক্রি করা হচ্ছে। বছরের পর বছর এভাবে চললেও দেখার কেউ নেই। কারণ, খোদ বন বিভাগের কর্মকর্তারাই যে এ অপকর্মের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা রাখছেন স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এবং কিছু নামধারী ‘সাংবাদিক’। গহিন এ অরণ্যে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বাস করে কিছু পরিবার। তবে বন কর্মকর্তাদের গড়ে তোলা এ সাম্রাজ্যে বলতে গেলে তাদের কোনো অধিকারই নেই। গাছ ও পাহাড় কাটাসহ নানা অনিয়ম চললেও তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করার জো নেই এ মানুষগুলোর। উল্টো অনেকেই বিনা মজুরিতে এসব কাজ করে দিতে বাধ্য হন। কারণ, হুকুমমতো না চললেই নেমে আসে মামলার খড়গ।”
২০০৭ সালে মে মাসের কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। দেশে তখন সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। একজন বনখেকো, বনের রাজা ওসমান গনির বাসায় বালিশের ভেতর, চালের ড্রামে, ওয়ার্ডরোবে খুঁজে পাওয়া যায় কোটি টাকা। সেই কোটি টাকায় আয়েশি জীবন ছিল ওসমান গনির। কিন্তু ওসমান গনির মা ভিক্ষা করতেন। ছেঁড়া কাপড় ছিল পরনে। দু’মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততেন। বিচারে ওসমান গনির ১২ বছর সাজা হয়। সেইসঙ্গে আদালত ওসমান গনির নামে থাকা ১ কোটি ৮০ লাখ ও স্ত্রীর নামে থাকা ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং ২৭০ ভরি স্বর্ণালংকার রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করেন। স্ত্রী-সন্তানরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আজ ওসমান গনি একা। কিন্তু এতে বন বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘ওসমান গনিদের’ কোনো বোধোদয় হয়নি। তারা নিজেদের মতো করে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার কাজটি অব্যাহত রেখেছেন। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করাচ্ছেন। এসব দেখার যেন কেউ নেই। বন বিভাগের প্রায় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ একর জমি জবরদখল হয়ে গেছে। বনভূমি বেদখল, অবৈধভাবে বনভূমি বরাদ্দ কিংবা তার ব্যবহারের সঙ্গে বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একাংশের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে যোগসাজশে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। এখানে বাস্তবে রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। অধিদপ্তরের নিয়োগ-পদোন্নতি ও বদলি এবং অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার আর্থিক অনিয়মে প্রতিষ্ঠানটি জর্জরিত।
বন উজাড় ও দখল এবং আত্মসাৎকেন্দ্রিক দুর্নীতির বিস্তার রোধে সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বন অধিদপ্তর কর্তৃক পদক্ষেপ দেখা যায় না। এর অন্যতম কারণ প্রভাবশালীরাই এর সঙ্গে জড়িত। আমাদের প্রত্যাশা, বন উজাড়ের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।