ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে তুখোড় ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। শহীদ আসাদ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের গণআন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা আসাদ ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের এবং মা মতি জাহান খাদিজা খাতুন।
আসাদ ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ’৬৬ সালে বিএ ও ’৬৭ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ বছরই তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং কৃষক সমিতির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নির্দেশনায় কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা এবং নরসিংদী এলাকায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। শহীদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল (বতর্মান শহীদুল্লাহ হল) শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু-মেনন গ্রুপ), ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালি ছাত্রদের ১১ দফা কর্মসূচির মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে জীবন দেন ছাত্রনেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আসাদ। আসাদ শহীদ হওয়ার পর তিন দিনের শোক পালন শেষে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতে সর্বস্তরের মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার নামে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথে। সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। মূলত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আসাদের আত্মত্যাগ সে সময় চলমান আন্দোলনের গতিকে তীব্র পর্যায়ে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয় স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের। তবে আরেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সত্তর সালের সেই অভূতপূর্ব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া ক্ষমতা না ছাড়াতে নানা টালবাহানা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তর সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
আসাদের সেই আত্মত্যাগের এক গভীর আবেগ এবং সে সময় গণআন্দোলনে তার কী গভীর ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল, তাই ধ্বনিত হয়েছে প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের কবিতা ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায়। কবি লিখেছেন, ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের;/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট;/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়। বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে;/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো;/হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষ্মতায়;/বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট;/উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।;/ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত;/মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট;/শহরের প্রধান সড়কে;/কারখানার চিমনি-চূড়োয়;/গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে;/উড়ছে, উড়ছে অবিরাম;/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,/চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।…’
শহীদ আসাদ এ দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের মধ্যে চিরজাগরূক এক নাম; যেই নাম সর্বদা মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে পথ দেখায়।