১৯৯০ সালে মিলান কুন্ডেরার দীর্ঘতম উপন্যাস ‘ইমমর্ট্যালিটি’ বা ‘অমরত্ব’ প্রকাশিত হয়। ফেবার প্রকাশনী প্রকাশিত হৃষ্টপুষ্ট এ উপন্যাসের আয়তন ছিল ৩৮৬ পাতা। যে কারণে ১৯৯০ সাল কুন্ডেরার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল সেটা হচ্ছে, ১৯৪৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ৪২ বছর পার হয়েছে এবং ১৯৬৮ সালে কুন্ডেরার প্রথম দুটো উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরও ২২ বছর পার হয়েছে। সেই ১৯৬৮ সাল যখন রুশ সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক ‘প্রাগ বসন্ত’-কে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। প্রাগ বসন্তের প্রেক্ষাপটেই কি কুন্ডেরার সফলতম দুই উপন্যাস ‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ ও ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’ প্রকাশিত হয়নি? এবং ১৯৭৫ সালে প্যারিসে আত্মনির্বাসন নেওয়ার পরও ১৯৯০ নাগাদ কেটে গেছে আরও ১৫টি বছর, যখন তিনি নিজের ভেতরের আশাগাছটি মুড়িয়ে ফেলেছেন যে, ‘চেক সমাজতন্ত্র’-এর ‘সংস্কার’ হবে। এক জীবনের দুঃখদায়ী সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পরও কেটে গেছে আরও অনেকটা সময়। তাই ১৯৯০-এ কুন্ডেরার ‘ইমমর্ট্যালিটি’ যেন সেই উপন্যাস যেটা পুরোপুরি ‘পশ্চিমে’র প্রেক্ষাপটে লেখা—‘পূর্ব ইউরোপ’ আর এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নয়—এখানে আর কমিউনিস্ট পার্টির বিবরণ, ইতিহাসের নানা তত্ত্ব এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর লেখকের প্রিয় স্বদেশভূমি চেকোস্লোভাকিয়ার বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর কোনো উল্লেখ নেই। তবে সাহিত্য সমালোচকদের মতে, মূল স্বদেশভূমি ও তার রোজকার নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন থেকে দূরে থাকার ফলে ‘ইমমর্ট্যালিটি’ উপন্যাসে কোথাও যেন কল্পনাশক্তির প্রাবল্য ও তাড়না কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে ‘ইমমর্ট্যালিটি’ বা ‘অমরত্ব’ উপন্যাসে যে তিনটি প্রধান দিক দেখা যায়, তা হলো : প্রথমত, রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টির বদলে এক ধরনের হাহাকার বা বিলাপ-বেদনা। পশ্চিমের জীবন নিয়ে নানা আক্ষেপসহ লেখক নিজেই উপন্যাসের পঞ্চম পাতায় হাজির এবং পশ্চিমের জীবন নিয়ে তার প্রধান অভিযোগগুলো সংক্ষেপে হলো—কুন্ডেরা ভোক্তা বা কনজিউমার শব্দটি অপছন্দ করেন, চারপাশ থেকে তার দিকে ধেয়ে আসা রক মিউজিক খুবই অপছন্দ করেন, পশ্চিমা সভ্যতায় চতুর্দিকের সবকিছুই যে ‘ফটেগ্রাফে বন্দি হতে হবে’ এটা তিনি অসম্ভব অপছন্দ করেন (‘ক্যামেরার লেন্স ছড়িয়ে আছে সর্বত্র—দ্য লেন্স ইজ এভরিহোয়্যার’ এবং ‘ঈশ্বরের চোখ ক্যামেরা দিয়ে প্রতিস্থাপিত’)। দ্বিতীয়ত, কেন ‘ইমমর্ট্যালিটি’তে লেখকের কণ্ঠস্বরকে ‘প্রবীণ’ মনে হয়? প্রাগ বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা প্রথম দুই উপন্যাসের টানটান তীব্রতা না থাকলেও এ উপন্যাসে আছে তার ‘ঠাট্টা’ উপন্যাসের মতোই এক ধরনের কৌতুক। ‘ঠাট্টা’য় যেমন নায়ক লুডভিগ বয়সে তরুণ এবং কঠোর স্বভাবের এবং তার সঙ্গে ঘটতে থাকা সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার গুরুত্বই সে যেমন বুঝে উঠতে পারে না এবং হেলেনা জেমানেককে অপমান করার জন্য লুডভিগের যাবতীয় পরিকল্পনাই যত ‘অনৈতিক’ হোক, তা পাঠককে হাসায় এবং জীবন্ত। ‘ইমমর্ট্যালিটি’-তে এসে ‘প্রাগ বসন্তে’র সেই তরুণ তুর্কি বা ছটফটে ছোকড়া হয়ে উঠেছেন এক ক্লান্ত ও শ্রান্ত সত্তা। তার আগের উপন্যাসগুলোয় যেখানে কি না কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষ, প্রচলিত প্রজ্ঞা, নারীর তিরস্কার—সবকিছুর বিরুদ্ধে তার নায়করা রুখে দাঁড়াচ্ছে—জীবন নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা যত ভুলই হোক, কোথাও যেন লড়াইয়ের মোরগের মতো সেই তরুণ তুর্কিরা অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী (লুডভিগ এবং টমাসের কথা এ ক্ষেত্রে বলতেই হবে)। অথচ গোটা ‘ইমমর্ট্যালিটি’র সুরটাই যেন পরাজিত এবং বিষণ্নতার সুর। এসবের পরও সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত কুন্ডেরার এ উপন্যাসে পাঠকের ভালোলাগার মতো কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো : প্রথম অধ্যায়—মুখশ্রী : কুন্ডেরা প্রথম অধ্যায়ের ৪৪তম পাতায় এক মাঝবয়সী মহিলার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। ভদ্রমহিলার নাম অ্যাগনেস। অ্যাগনেস বিবাহিতা এবং সে তার বর পলের সঙ্গে নানা বড় বড় ভাবনা এতটাই তির্যক কৌতুকের সঙ্গে আলোচনা করে, যা শুধু কোনো উপন্যাস অথবা নাটকে দেখা যায়। অ্যাগনেস গাড়ি চালিয়ে ‘সনা এবং স্বাস্থ্য ক্লাব’-এ যায়। তার বাবার কথা মনে পড়ে যিনি সবার মৃত্যু কামনা করতেন। কিন্তু হুট করে একদিন অ্যাগনেসের মা মারা যান কিন্তু বাবা বেঁচে থাকেন। একদিন অ্যাগনেসের বোন তাদের বাবার কাছে এসে দেখেন যে বাবা তার বিয়ের ছবি ছিঁড়ে ফেলছেন এবং এতে অ্যাগনেস ও তার বোন খুব ক্রুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়—অমরত্ব : এরপরই যেন চলচ্চিত্রের জাম্প কাট শটের মতো কুন্ডেরা নিয়ে যান আমাদের ইতিহাসের পাতায় যেখানে মহান জার্মান কবি গোয়েথে ১৮১১ সালে নেপোলিয়নের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। দৃশ্যটি সংক্ষিপ্ত যেহেতু চির অমর সমরবিদ নেপোলিয়নের কাছে তার সহযোগী বা সহকারীরা বারবার আসছে ও যাচ্ছে। এ দৃশ্যটির মাধ্যমে কুন্ডেরার আজকের এ উত্তরাধুনিক পৃথিবীতে পাপারাজ্জি ও ক্যামেরার সর্বত্রগামিতার কথাও তুলে ধরেছেন। খ্যাতি কি মানুষকে অমর করে সেই প্রশ্নে এ উপন্যাসটি দেখাচ্ছে বৃদ্ধ হতে থাকা গোয়েথে বা গ্যোটের প্রতি বেট্টিনা ভন আর্নিম নামে এক তরুণীর প্রায় সারমেয়সুলভ ভক্তি। এখানে কুন্ডেরা বেট্টিনার গোটা জীবনী তুলে ধরে দেখাচ্ছেন যে, বেট্টিনা আসলে তেমন এক নারীর কন্যা যে নারীকে যৌবনে গোয়েথে নিজেই কামনা করেছেন। ত্রিশ পাতা জুড়ে কুন্ডেরার বর্ণনায় বোঝা যায় যে, গোয়েথের প্রতি তার প্রচণ্ড অনুরাগ একটা পর্যায়ে গোয়েথেকে প্রতিটি মুহূর্তে অনুসরণের পর্যায়ে এসে পৌঁছায়। বৃদ্ধ গোয়েথেকে চিঠির পর চিঠির বোমা হামলায় ব্যস্ত রাখত বেট্টিনা এবং তার দেওয়া সব উত্তর জমিয়ে রাখত। কিন্তু ১৮৩২ সালে কবির মৃত্যুর পর, বেট্টিনা কবিকে পাঠানো নিজের লেখা সব চিঠি এবং গোয়েথের সংক্ষিপ্ত উত্তরগুলো বদলে দিয়ে এমন ভাবে সাজান যাতে মনে হয় যে, গোয়েথে সত্যিই তার প্রেমে পড়েছেন এবং তারপর ‘আ চাইল্ডস করেসপন্ডেন্স উইথ গোয়েথে’ বা ‘গোয়েথের সঙ্গে এক শিশুর পত্রাবলি’ শিরোনামে একটি মোটা বই-ই প্রকাশ করেন। এ ঘটনার পর বেট্টিনা গোয়েথেকে নিয়ে নানা কিংবদন্তির একটি অংশই হয়ে ওঠেন এবং গোয়েথে সম্পর্কে তার জীবনীকাররাও বেট্টিনার সঙ্গে তাকে জড়িয়েছেন। কিন্তু সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯২০ সালে মেয়েটিকে লেখা বৃদ্ধ কবির আসল চিঠিগুলো পাওয়া যায় এবং গোয়েথের বিরুদ্ধে ‘শিশুর সঙ্গে প্রেমের অভিযোগ’ মুছে যায়। সত্যি কথা বলতে কুন্ডেরা পশ্চিমের ‘সেলিব্রেটি প্রচার যন্ত্র’ এবং এর অনিঃশেষ প্রেস ও পাবলিক রিলেশনসের যত চাতুর্য, বই নিয়ে নানা অনুষ্ঠান, ইন্টারভিউ ও টিভিতে প্রচারিত তথ্যচিত্র দেখে ক্লান্ত হয়ে উঠছেন। এরপরই এক পরাবাস্তব মোচড়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ তিনটি ছোট ছোট পরিচ্ছেদে কুন্ডেরা গোয়েথেকে কল্পনা করছেন স্বর্গে হাঁটাহাঁটি করতে এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে কথা বলতে। কেন? কারণ বোধকরি বিশ শতকের লেখকদের ভেতর হেমিংওয়ের মতো নিজের জীবন-শো-অফ, নারীপ্রীতি, নারীবিদ্বেষসহ নানা কারণে এত সমালোচিত আর কেউ হয়নি। কাজেই অমরত্ব বা ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ বোঝাতে গোয়েথে দুঃখ ভরে বলছেন, ‘অমরত্ব হচ্ছে অনন্ত এক কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা।’ আসলে পূর্ব ইউরোপে ক্ষমতার মুখে সত্য কথনের দায়ে কুন্ডেরা যখন ‘ভিন্ন মতাবলম্বী’ হিসেবে অভিযুক্ত এবং পশ্চিমে একই কারণে নন্দিত, সেই তিনিই যখন পশ্চিমে থিতু হয়ে গেলেন এবং আর দশজন পশ্চিমা লেখকের মতোই ইচ্ছে খুশি লেখার স্বাধীনতা পেলেন, তখন দেখলেন যে, পশ্চিমেও অসংখ্য সমালোচক যেন এক খ্যাতিমানের নিশ্ছিদ্র সমালোচনার সুযোগ খুঁজছেন, হাজার হাজার ভার্সিটির সেমিনার কক্ষে নারীবাদীরা তাকে ‘খলনায়ক’ বানিয়ে ছাড়ছেন। তৃতীয় অধ্যায়—লড়াই : এ অধ্যায়টি গোটা উপন্যাসের দীর্ঘতম অধ্যায় যার আছে অসংখ্য উপবিভাগ। যেমন, উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে কুড়ি শতকের ফ্রান্সের অ্যাগনেস এবং তার বোন লরার পরই হুট করে ঔপন্যাসিকের আমাদের উনিশ শতকের জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া। বলে রাখা ভালো যে, কুন্ডেরা জার্মানি এবং জার্মান সংস্কৃতির খুব অনুরক্ত ছিলেন, যে জন্য তার একাধিক গল্পে চেক কম্পোজার দভোরাক বা জানাচেকের বদলে বিঠোফেন উঠে আসেন। উপন্যাসের শুরুতে অ্যাগনেস এবং লরা নামের দুই বোনকে সারাক্ষণই এক দ্বন্দ্বের ভেতর দেখা যায় : দুই বোন সানগ্লাস পরে সম্পূর্ণ দুই ভিন্ন কারণে। লরা ভালোবাসে ঘরে থাকতে এবং সারাক্ষণই সে দৈহিক কামনায় ভরা যখন কি না অ্যাগনেসের কখনোসখনো দৈহিক উত্তেজনা হয়। তবে এসব খুঁটিনাটির চেয়ে ‘ইমমর্ট্যালিটি’-তে যেটা পাঠককে টানবে সেটা হলো, পশ্চিমে সবকিছুর এত বেশি ‘প্রাচুর্যে’ কুন্ডেরার ক্লান্তি। যেমন একটা জায়গায় লেখক বলছেন, ‘আমাদের পৃথিবীতে যেখানে যত বেশি বেশি মুখচ্ছবি, সব মুখই যেন একই রকম, কারও মুখ দেখে আলাদা করা যায় না। পশ্চিমের দৈত্যাকৃতি প্রাচুর্য দেখে কুন্ডেরা ভাবছেন যে, এখানে মানুষ যেন গাড়ির মডেলের মতো, একই মডেলের অসংখ্য গাড়ির মতো ব্যক্তিসত্তাহীন। পশ্চিমের শত শত বেতার চ্যানেলে একই রকম যেন শব্দ-ঝঙ্কার এবং শেষ হিট পপ গানের সঙ্গে শেষ বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল আলাদা করা যায় না। কুন্ডেরা আরও দুঃখ করেন যে, আধুনিক সাংবাদিকরা আর ঘটনার বয়ানে না গিয়ে সবাইকে ইন্টারভিউ করে এবং এমনভাবে ইন্টারভিউ করে যে, যেন প্রাচীনকালের টাকা পাওয়া গ্ল্যাডিয়েটররা ইন্টারভিউদাতাকে অপমান করতে নেমেছে। একইভাবে ধারাবর্ণনাকারী অভিযোগ করেন যে, কীভাবে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ছাপিয়ে বিভিন্ন ‘মতামত জরিপ’ বা অপিনিয়ন পলগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে—এসব জরিপ চালনাকারী সংস্থাই নির্ধারণ করে যে, কীভাবে বিজ্ঞাপন ও ফ্যাশন ভুবন চলবে, সংবাদপত্র-টিভি-বেতারে কী কী চলবে এবং কীভাবে উপস্থাপিত হবে। উপন্যাসে তাই অ্যাগনেসের বর পল পরিতাপ করে যে, কীভাবে মোরাভিয়ায় তার পিতামহী তার ছোট্ট গ্রামটির সবাইকে চিনতেন, জানতেন কীভাবে সবকিছু নির্মিত হয়—বাড়ির নকশিকাঁথাটি থেকে খাবার এবং সব পাড়াপড়শি সম্পর্কেই তিনি জ্ঞান রাখতেন, যখন কি না প্যারিস শহরে তার প্রতিবেশীরা সকালে গাড়ি চালিয়ে কাজে বের হয়ে যায়, সহকর্মীদের থেকে খানিকটা দূরত্বে সারা দিন বসে থাকে, তারপর আবার গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে টিভি খোলে এবং ভাবে যে টিভিতে যা কিছু বলা হয়, সেটাই বুঝি সত্য। কুন্ডেরা কিন্তু পশ্চিমে এসে তার ‘পুঁজিবাদী’ সত্তাকেও ঠিক পছন্দ করতে পারছেন না। যেমন, কাহিনির নায়িকা অ্যাগনেসের বর পল আইনজীবী হলেও একটি রেডিওতে অনুষ্ঠান সঞ্চালক হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ করেন। কিন্তু একপর্যায়ে রেডিও স্টেশনের পরিচালক পলকে তার চাকরি থেকে ছাঁটাই করে। পল আইনজীবী হিসেবে কাজ চালিয়ে গেলেও মনের ভেতরে একটা সূক্ষ্ম বিষাদবোধ তার সহজে কাটে না। পল এবং অ্যাগনেসের ব্রিজিত নামে একটি তরুণী কন্যা আছে। সে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। ১৯৬৮ সালের প্যারিস বসন্তের সময় পল শহরের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছেন। তার কাছে কিশোর ফরাসি কবি র্যাঁবো যেন ছিলেন কুড়ি শতকের চে গুয়েভারা, মাও এবং জাঁ পল সার্ত্রের সমরূপ কেউ একজন। যে বুর্জোয়া জীবনকে তরুণ বয়সে এত ঘৃণা করতেন পল, আজ স্ত্রী-কন্যার দাবি মেটাতে সে নিজেই হয়ে উঠছেন বুর্জোয়া ব্যবস্থার একজন আজ্ঞাবাহী দাস। চতুর্থ অধ্যায়—হোমো সেন্টিমেন্টালিস : চতুর্থ অধ্যায়ে কুন্ডেরা যেন প্রেম, আত্মা ও অনুভূতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন এক উপাদেয় কেক। এ অধ্যায়ে এসে পুনরায় বৃদ্ধ গোয়েথের জন্য তরুণী বেট্টিনার প্রণয়বোধের কথা বলা হয়েছে এবং বিশ শতকে রিলকে, রোমা রোঁলা এবং এলুয়ারের মতো লেখকরা কীভাবে বেট্টিনার পক্ষে এবং মূলত যৌবনে বেট্টিনার মায়ের প্রেমে পড়া গোয়েথের এ মেয়েটির প্রতি কোনো রোমান্টিক অনুভূতি বর্জিত শীতলতার সমালোচনা করেছেন এবং একই সঙ্গে গোয়েথের মোটাসোটা, কৃষক স্ত্রীর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন। এরপরই রিলকে দ্বাদশ শতকের ত্রুবাদুর কবিদের প্রেমগীতির উল্লেখ থেকে ঝট করে উপস্থিত হন দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাসের হৃদ-মাঝারে, সেখান থেকে চলে যান ডন ক্যুইক্সোটের প্রেমদৃশ্যগুলোয়। তারপরই কুন্ডেরা জানাচ্ছেন যে, কীভাবে একবার বিঠোফেন গেছেন ওয়েইমার রাজ্যে গোয়েথেকে দেখতে এবং সংগীত ও সাহিত্যের দুই মহত্তম প্রতিভা হাঁটতে বের হয়ে সহসা দেখলেন যে, খোদ রাজ্যের সম্রাজ্ঞী তাদের দিকেই আসছেন। গোয়েথে যদিবা থেমে গিয়ে তার মাথার টুপি খুলে নত হলেন, অহংকারী বিঠোফেন তার মাথার টুপি আরও শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটা চালিয়ে গেলেন, একবার থামলেনও না এবং দুই হাত পিঠে শক্ত করে চেপে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। পঞ্চম অধ্যায়—সুযোগ : উপন্যাসের পঞ্চম অধ্যায়ে কুন্ডেরা নিঃশব্দ কাকতালীয় ঘটনা, কাব্যিক কাকতালীয় ঘটনা, পরস্পরবিরোধী নানা কাকতালীয় ঘটনা, গল্পের জন্ম দেওয়া নানা কাকতালীয় ঘটনা এবং অসুস্থ কাকতালীয় নানা ঘটনার জন্ম দেন। ষষ্ঠ অধ্যায়—ঘড়ির মুখ : ষষ্ঠ অধ্যায়টি শুরুতে নিষ্প্রভ মনে হলেও পরে আগ্রহোদ্দীপক লাগে। এখানে শৈশবেই যেন খুব ‘আঁকা’র ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে এমন কাউকে স্কুলে ভর্তি হতে দেখা যার নাম ‘রুবেন্স’। তা আঁকিয়ে জীবনের শুরুতে এই রুবেন্স বেশ ভালো করলেও পরবর্তী জীবনে সে তেমন সুবিধা করতে পারে না এবং তখন আঁকা ছেড়ে দিয়ে সে নারীর পেছনে ছোটে। যৌবনে যদিও এই রুবেন্স ভাবতেন যে গোটা পৃথিবী তার সামনে পড়ে আছে, কিন্তু শিল্পী হিসেবে ব্যর্থ হওয়ার পর ‘জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার’ কথা ভাবলেন। কিন্তু বৃদ্ধ হতে শুরু করার পর এই রুবেন্সের মনে হলো এত যে নারীসঙ্গ করেছেন, কোনো একটি নারীসঙ্গের কথা তিনি পরিপূর্ণভাবে স্মরণ করতে পারছেন না। আঁকা ছেড়ে দিয়ে নারীসঙ্গইবা তিনি ‘পূর্ণতা’ কই পেলেন? সপ্তম অধ্যায়—উদযাপন : উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে পল ও তার মৃত স্ত্রী অ্যাগনেস, অ্যাগনেসের বোন লরাকে পলের বিয়ে করা এবং পলের মেয়ে ব্রিজিত—সবাইকে মিলিয়ে নব্বইয়ের দশকের পশ্চিমা পুঁজিবাদের অসুখী যাপনই কুন্ডেরার এ আখ্যানের শেষ প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়ায়। কৃতজ্ঞতা : পিটার কুসসি কর্তৃক চেক থেকে ইংরেজিতে অনূদিত ‘দ্য ইমমর্ট্যালিটি’ এবং astrofella.wordpress.com
মন্তব্য করুন