নোয়াখালীর নাম জড়িয়ে ‘গান্ধীর ছাগল চুরি’ নিয়ে জনশ্রুতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনমনে নেতিবাচক আলোচনার ঝড় বইছে। তবে বিভিন্ন মহল থেকে ছড়িয়ে পড়া এই বিভ্রান্তিকর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মহাত্মা গান্ধীর কোনো ছাগল চুরি হয়নি, এটা নিছক রিউমারস এবং ইতিহাস বিকৃতির একটি অপচেষ্টা।
নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূর সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ ইউনিয়ন। সোনাইমুড়ী-চাটখিল ও রামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের জয়াগ বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট। দূর থেকে চোখে পড়বে গান্ধী ট্রাস্টের সামনে স্থাপন করা মহাত্মা গান্ধীর বিশাল আকারের ভাস্কর্য। জনশ্রুতি আছে, এই জয়াগ গ্রামেই গান্ধী তার ছাগল হারিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ২৯ জানুয়ারি গান্ধী জয়াগ গ্রামে আসেন। এখানে তিনি গ্রামের জমিদার হেমন্ত কুমার ঘোষের বাড়িতে ওঠেন। পরে গান্ধীর স্মরণে হেমন্ত কুমারের দান করা জায়গায় গড়ে ওঠে গান্ধী ট্রাস্টসহ বেশ কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা জানিয়েছেন, গান্ধীজি ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী সফরে আসেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে। তার সফরের সময় বা পরবর্তী কোনো ইতিহাসে ছাগল চুরির কোনো প্রমাণ নেই। গান্ধীর ব্যক্তিগত সহচরদের স্মৃতিচারণাতেও এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ মেলে না। এমনকি এ নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রুথ’ বইতেও কোনো কিছুর উল্লেখ নেই।
স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা জানিয়েছেন, ১৯৪৬ সালের আগস্টে কলকাতার দাঙ্গার প্রভাব পড়ে নোয়াখালীতেও। হিন্দু-মুসলিম সহিংসতায় ২৮৫ জনের মৃত্যু, অসংখ্য ঘরবাড়ি পোড়ানো এবং ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে গান্ধী ৭ নভেম্বর নোয়াখালী আসেন। চার মাস ধরে ৪৭টি গ্রাম পরিদর্শন করে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। তার সফরে জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতারা অংশ নেন।
গান্ধী শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনই করেননি, গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরামর্শ দিয়েছেন। মুসলিম বাড়িতে গিয়ে কালাজ্বরে আক্রান্তদের চিকিৎসা করেছেন, মসজিদ পরিদর্শন করেছেন এবং সব ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করেছেন। তার সফরের পর নোয়াখালীর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়।
গান্ধী বাছুরকে বঞ্চিত করে গরু বা মহিষের দুধ পানের বিরোধী ছিলেন। এ বিষয়ে তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও ছিল। কিন্তু ১৯১৯ সালের দিকে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার চিকিৎসক জানান, সুস্থ হতে হলে তাকে দুধ পান করতেই হবে। তখন গান্ধী জানালেন, তিনি গরু ও মহিষের দুধ পান থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। তবে স্ত্রী কস্তুরবা পণ ভঙ্গ না করেই ছাগলের দুধ পানের পরামর্শ দেন গান্ধীকে। কস্তুরবার যুক্তি ছিল, মহিষ ও গরুর দুধ পান না করার প্রতিজ্ঞা ছিল। তাহলে ছাগলের দুধ খেলে সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হচ্ছে না।
গান্ধী অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই প্রস্তাবে সম্মত হন। যদিও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এতে তিনি তার প্রতিশ্রুতির মূল চেতনা লঙ্ঘন করছেন। তার আত্মজীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রুথ’ এ তিনি নিজের এই দ্বন্দ্বের সমালোচনাও করেছেন। পাশাপাশি জ্ঞানী ব্যক্তিদের আহ্বান জানিয়েছেন, যদি কেউ ছাগলের দুধের বিকল্প হিসেবে পুষ্টিকর কোনো উদ্ভিজ্জ খাবারের কথা জানেন, তা যেন তাকে জানান। কিন্তু এমন বিকল্প তখনো ভারতবর্ষে এসে পৌঁছায়নি। গান্ধীকে তাই ছাগলের দুধ পান করতে হলো। ১৯৩১ সালে তিনি যখন লন্ডন সফরে যান, তখন সঙ্গে ‘নির্মলা’ নামের একটি ছাগলও ছিল। সে সময় টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন ও ছবি থেকে এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়।
চাটখিল মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফারুক সিদ্দিকী ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, ‘এমন জনশ্রুতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু ঐতিহাসিক নথি, গান্ধীর আত্মজীবনী এবং তৎকালীন সংবাদপত্রে এই ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। এটি একটি ভুয়া কাহিনি, যেটিকে ইতিহাসের আড়ালে রোপণ করে নোয়াখালী এবং এখানকার মানুষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। মূলত প্রতিহিংসাপরায়ণ কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ধরনের প্রচারণা চালিয়ে আসছে, যা নিছক প্রোপাগান্ডা ও ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর।’
গান্ধী ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক মো. নুর নবী কালবেলাকে বলেন, ‘গান্ধী গরু বা মহিষের দুধ পান থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে মারাত্মক অসুস্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ছাগলের দুধ পান শুরু করেন। ১৯৩১ সালে লন্ডন সফরে গিয়েও তিনি ‘নির্মলা’ নামের একটি ছাগল সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে নোয়াখালী সফরে ছাগল চুরির ঘটনা তার আত্মজীবনী বা সফরসঙ্গীদের দিনপঞ্জিতে উল্লেখ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘নোয়াখালীর মানুষ গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা করে এবং তিনি এখানে ভালোবাসা পেয়ে ছিলেন। সম্প্রতি কোনো একটি মহল প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নোয়াখালীর মানুষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই গুজব ছড়াচ্ছে।’
এ বিষয়ে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টে সচিব রাহা নবকুমার কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ২৭ বছর ধরে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টে কাজ করছি। ট্রাস্টে যোগদানের আগে থেকেই গান্ধীর ছাগল চুরি হওয়ার কথা শুনেছি। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার আত্মজীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রুথ’ মনোযোগ সহকারে পড়েছি, নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর সফরসঙ্গীদের লেখা পড়েছি। ওইসব লেখায় ছাগল চুরির কোনো তথ্য ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গান্ধীর সঙ্গীরা সবাই মহাত্মা গান্ধীর প্রতিদিনকার কর্মসূচির দিনপঞ্জি আকারে লিখেছেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে দিনপঞ্জিতে অবশ্যই তা থাকত। সে কারণে পুরো বিষয়টি লোকমুখে ছড়ানো গালগল্প বলেই মনে হয় আমার কাছে।’
মন্তব্য করুন