বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২
কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য শরিয়াভিত্তিক হাউস-কার লোন চালুর পরামর্শ আহমাদুল্লাহর

বক্তব্য রাখেন আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ। ছবি : কালবেলা
বক্তব্য রাখেন আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ। ছবি : কালবেলা

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য শরিয়াভিত্তিক বাড়ি ও গাড়ি কেনার ঋণ চালুর পরামর্শ দিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা ইসলামী আলোচক ও আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ইসলামি নীতিমালা মেনে চলতে চান। তারা শরিয়াহসম্মত উপায়ে ঋণ নিতে আগ্রহী হলেও বর্তমানে এমন কোনো সুযোগ না থাকায় তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। যদি তাদের জন্য শরিয়াভিত্তিক হাউস লোন বা কার লোনের সুযোগ রাখা হয়, তবে তা হবে সময়োপযোগী ও ন্যায়সঙ্গত উদ্যোগ।

মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীতে বাংলাদেশ ব্যাংক আয়োজিত পবিত্র সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত হয়ে তিনি এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. জাকির হোসেন চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. আনিচুর রহমান এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আফতাব উদ্দিন।

শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, তারা হাউস লোন বা গাড়ি লোনের ক্ষেত্রে শরিয়াহ অনুসরণ করতে চান। কিন্তু বর্তমানে তেমন কোনো পদ্ধতি বা টুলস না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে সুদনির্ভর লোন গ্রহণ করেন। অথচ তারা ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় লেনদেন করতে চান।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং যারা দ্বীন পালন করতে চান, তাদের জন্য শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের পথ খোলা রাখবে।

তিনি বলেন, আমরা কাউকে বাধ্য করতে বলছি না, বরং বলছি, যারা শরিয়াহভিত্তিক পথে লেনদেন করতে চান, তাদের জন্য বিকল্প একটি পথ থাকা উচিত। এটি শুধু ধর্মীয় দায় নয়, নৈতিক দায়িত্বও বটে।

শরিয়াহ পালনে ইসলামী ব্যাংকগুলোর জবাবদিহিতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, দেশে ইসলামি ব্যাংকগুলো ঠিকভাবে শরিয়াহ মেনে চলছে কি না, তা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, যেমন ইসলামী ব্যাংকিং পলিসি বিভাগ ও কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ড গঠন, তা সঠিক পথে একটি বড় অগ্রগতি।

তিনি আরও বলেন, ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয় এবং ২০০৯ সালে গঠিত হয় সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ (CSBIB)। কিন্তু তখন এর নির্দেশনা ব্যাংকগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা গ্রহণ করেছে, তা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ভিত্তি শক্ত করতে সহায়ক হবে।

শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, অনেক মানুষ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রকৃত ধারণা জানেন না। যেমন বিবাহ ও ব্যভিচারের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির কারণে একটি হালাল, আরেকটি হারাম—ব্যাংকিং ক্ষেত্রেও তাই। শরীয়াহসম্মত পদ্ধতি মেনে লেনদেন হলে তা বৈধ, না হলে অবৈধ। তাই ব্যাংকগুলো উচিত এমন একটি সার্ভিস সিস্টেম চালু করা, যাতে গ্রাহক বুঝতে পারেন কোন লেনদেন শরিয়াহসম্মত আর কোনটি নয়।

তিনি বলেন, যিনি ব্যাংকিং করছেন, তার অধিকার আছে জানার যে, তার আমানত ও বিনিয়োগ শরীয়াহ অনুযায়ী চলছে কি না। ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ড নিয়ে সমালোচনা করে শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, অনেক ব্যাংকে শরীয়াহ বোর্ডে এমন ব্যক্তিদের রাখা হয়, যাদের ব্যাংকিং বা শরীয়াহ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। অনেক সময় পরিচিতি বা সামাজিক অবস্থানের কারণে তাদের রাখা হয়। এটি অত্যন্ত অনভিপ্রেত। শরীয়াহ বোর্ডে যোগ্য, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করলেই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে।

তিনি আরও বলেন, যিনি ব্যাংকিং বুঝেন না, শরিয়াহ জানেন না, তিনিই যদি শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হন, তাহলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি মান নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা তৈরি করতে হবে।

শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিকাশে এখন সবচেয়ে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ‘ইসলামী ব্যাংকিং আইন’। বর্তমানে অনেক ব্যাংক ইসলামী নামে প্রচলিত থাকলেও প্রকৃত শরীয়াহ মেনে চলছে কি না, তা জানার সুযোগ নেই। এজন্য আইনের মাধ্যমে নিয়ম-নীতিনির্ধারণ করা হলে প্রতারণা ও অনিয়ম কমবে।

তিনি বলেন, গ্রাহক যাতে বুঝতে পারেন—তিনি প্রকৃত ইসলামী ব্যাংকে লেনদেন করছেন কি না, এজন্য একটি স্বচ্ছ আইন থাকা প্রয়োজন। এখনই ইসলামী ব্যাংকিং আইন করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে আমরা সর্বজনীন পেনশন স্কিমে একটি ইসলামি ধারা যুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলাম। তখন সে প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে—এটা ইতিবাচক উদ্যোগ। আমরা সরকারকে এজন্য ধন্যবাদ জানাই।

তিনি বলেন, আমরা কখনোই বলিনি সবাইকে বাধ্য করা হোক। বরং যারা শরিয়াহভিত্তিক উপায়ে চলতে চান, তাদের জন্য যেন বিকল্প ধারা থাকে। মুসলমানরা সুদ থেকে বাঁচতে চান—এটি তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। সরকার যদি ইসলামী বিকল্প পথ খুলে দেয়, তবে মানুষ সেটি গ্রহণ করবে।

শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং এখন বাস্তব চাহিদায় পরিণত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ সুদকে হারাম মনে করেন এবং ইসলামী ব্যাংকিং সেবাই তারা নিতে চান। তাই প্রতিটি প্রচলিত ব্যাংককেও এখন ইসলামী উইন্ডো চালু করতে হচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে, মানুষ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নীতিনির্ধারক হলেও তারাই এখন শরীয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা, যেমন বিসিএস কর্মকর্তারা, সরকার নির্ধারিত নীতিমালায় ইসলামী ব্যাংক থেকে হাউজিং সুবিধা নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্যও এ সুযোগ থাকা উচিত।

তিনি ইসলামের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত টেনে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের দায়িত্ব দিতেন যোগ্যতা অনুযায়ী। আবু জর গিফারি (রা.) দায়িত্ব চান, কিন্তু নবী (সা.) বলেন—‘তুমি নরম প্রকৃতির মানুষ, দায়িত্ব শক্ত মানুষদের জন্য।’ আবার মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘরের চাবি নবী (সা.) দিলেন উসমান ইবনে আবি তালহাকে, যিনি বংশানুক্রমে তাতে অধিকৃত ছিলেন—যদিও আলী (রা.) তখন উপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ দায়িত্ব দিতে হবে যোগ্য ব্যক্তিকে।

এ প্রসঙ্গে আহমাদুল্লাহ বলেন, আমাদের ব্যাংকিং খাতেও সেই নীতি অনুসরণ করা উচিত। মুখ চেনা বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, যোগ্যতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে দায়িত্ব দিতে হবে।

তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা কোরআনে বহু জায়গায় ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন ও কর্মজীবন—সব ক্ষেত্রেই ইনসাফ করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকিং মানে শুধু সুদ এড়িয়ে চলা নয়, বরং ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেও ন্যায্যতা বজায় রাখা।

সবশেষ শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য যদি শরীয়াহভিত্তিক হাউজ বিল্ডিং ও কার লোন সুবিধা চালু করা হয়, তবে এটি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি আস্থা বাড়াবে। আমরা চাই না, এটি বাধ্যতামূলক হোক; তবে যারা চান, তাদের জন্য যেন সেই পথটি খোলা থাকে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং শক্তিশালী করতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। এখন শুধু দরকার বাস্তবায়নের দৃঢ়তা এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যুদ্ধের উসকানি দিয়ে শান্তির প্রতীক হওয়া যায় না, ট্রাম্পকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বাবার সঙ্গে আলোর শেষ কথা—আমরা আটকে গেছি

লাইভে এসে সংসদ ভেঙে দিলেন পালিয়ে যাওয়া মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট

মিরপুরে অগ্নিকাণ্ড : দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান তারেক রহমানের

ছাত্রশিবির সমর্থিত ভিপি প্রার্থীকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ

মেসি নন, নতুনদের নিয়েই পুয়ের্তো রিকোর মুখোমুখি আর্জেন্টিনা

বিএনপি কোনো দলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায় না : কফিল উদ্দিন 

বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান হাসপাতালে ভর্তি

পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে : পরওয়ার

নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে : লায়ন ফারুক

১০

ভারতের হারে এশিয়ান কাপ খেলার স্বপ্ন শেষ বাংলাদেশের

১১

সাবেক স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ, যুবক গ্রেপ্তার

১২

পর্তুগালসহ যেসব দল আজ নিশ্চিত করতে পারে বিশ্বকাপের টিকিট!

১৩

এক দিনের ব্যবধানে দেশে স্বর্ণের দাম আরও বাড়ল

১৪

সুস্থ থাকতে খেলাধুলার বিকল্প নেই : মেয়র ডা. শাহাদাত

১৫

ভুল বুঝিয়ে স্বাক্ষর নেওয়ায় প্রতিবন্ধীর প্রতিবাদ

১৬

হোয়াইটওয়াশ এড়াতে মিরাজদের সামনে বিশাল লক্ষ্য

১৭

চাকসুতে এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগ

১৮

গুমের শিকার পরিবারগুলোর মানববন্ধন / স্বজনদের ফেরত দিন, না পারলে জড়িতদের বিচার করুন

১৯

অগ্নিকাণ্ডে মৃত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে : ফায়ার সার্ভিস

২০
X