মাঝ আষাঢ়ে টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ফুলেফেঁপে উঠছে নদনদী। এক মাসে দুই দফা বন্যার পর আবারও ডুবেছে দেশের বিভিন্ন এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এ সময় জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় যমুনা নদীর পানি কিছুটা বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হতে পারে। এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে গত কয়েক দিনের তুলনায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমেছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, দেশে বর্তমানে সাত জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া, হাতিয়া ও চিলমারী, যমুনার পানি সাঘাটায়, সুরমার পানি কানাইঘাট, সিলেট ও সুনামগঞ্জে, কুশিয়ারার পানি অমলশীদ, শেরপুর-সিলেট, মারকুলি ও শেওলায়, মনু নদীর পানি মনু রেলব্রিজ ও মৌলভীবাজারে, খোয়াইয়ের পানি বল্লা ও মৌলভীবাজার এবং সোমেশ্বরীর পানি কলমাকান্দায় বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
পাউবো পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদনদীগুলোর পানির সমতল বাড়ছে, যা আগামী তিন দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, ভুগাই ও কংস নদ-নদীর পানির সমতল কমেছে। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল বেড়েছে, যা অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারি এবং ৪৮ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার নাগাদ জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদী সংলগ্ন কতিপয় পয়েন্টে পানির সমতল বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এই সময়ে কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদ-সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। পাউবো জানিয়েছে, বিভিন্ন নদ-নদীতে তাদের পর্যবেক্ষণাধীন ১১০টি স্টেশনের মধ্যে গতকাল পানি সমতল বেড়েছে ৮৩টিতে, কমেছে ২৭টিতে। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে ১৬ স্টেশনের পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, আজ ঢাকায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কম থাকবে। তবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হবে। সেইসঙ্গে রাজশাহী বিভাগেও বৃষ্টি তুলনামূলক কম থাকবে। আগামী অন্তত এক সপ্তাহের মধ্যে লঘুচাপ সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। জুলাই মাসে গড়ে ৫২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। আবহাওয়া অধিদপ্তর দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে জানিয়েছে, এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জুলাই মাসে বঙ্গোপসাগরে একটি বা দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে এবং যার মধ্যে একটি মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারের টেকনাফে সর্বোচ্চ ৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ ছাড়া কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, সারা দেশেই বৃষ্টি হলেও রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে তুলনামূলক বেশি বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন একটু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেশি থাকবে। আগামী ৫ ও ৬ জুলাই রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বেশি ঝরবে বৃষ্টি। ৬ জুলাইয়ের পরে কেবল রংপুর বিভাগে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেশি থাকবে।
তিনি বলেন, ১৯৪৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মোট ৭৬টি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। গভীর নিম্নচাপগুলো বাদ দিলে জুন মাসে হয়েছে পাঁচটি, জুলাই মাসে ১৯টি, আগস্ট মাসে ২১টি ও সেপ্টেম্বরে ২৫টি। জুনের পরেই নিম্নচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে জুলাই মাসে এবং সবচেয়ে বেশি থাকে সেপ্টেম্বরে।
নতুন করে প্লাবিত সিলেটের ১,১৬০টি গ্রাম: সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে তৃতীয় দফা বন্যায় ফের প্লাবিত হয়েছে জেলার ৯৭টি ইউনিয়নের ১ হাজার ১৬০টি গ্রাম। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৩৭৮ জন মানুষ। ১৪ দিন যেতে না যেতেই ফের তৃতীয় দফা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে সিলেট।
গতকাল দুপুরে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানায়, জেলার ১৩ উপজেলায় ৯১টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত। ১ হাজার ১৬০টি গ্রামের ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৩৭৮ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। জেলার ৬৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ৮ হাজার ৮২৮ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ১২৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ও প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কন্ট্রোল স্থাপন করে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম গঠন করে বন্যার্ত অসুস্থ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভারি বৃষ্টি হয়নি। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর এক তথ্যে জানিয়েছে, জুলাই মাসের প্রায় পুরো সময়জুড়ে সিলেটে থেমে থেমে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি চলতে পারে।
এদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় সৃষ্ট তৃতীয় দফা বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তিন নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে আছে। পানিবন্দি মানুষ ও আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।