পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের এক ধরনের শীতল সম্পর্ক সবসময়ই ছিল। বর্তমানে সেটা এক ধরনের উষ্ণ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মহ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ায় পুরো বিশ্বের সঙ্গেই বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্পর্কের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে ড. ইউনূস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অধিবেশনের ফাঁকে সেখানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। বৈঠকগুলোয় বিশ্বনেতারা অন্তর্বর্তী সরকারকে জোরালো সমর্থনের পাশাপাশি সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় সর্বাত্মক সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা ধরে বৈঠক হয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো এমন বৈঠক বিরল। গত ২৫ বছরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের প্রথম বৈঠক এটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এদিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি থাকবে পূর্ণ সমর্থন। দুই নেতার সাক্ষাতের পর হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে আরও সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে তার নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ ছাড়া অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। সংক্ষিপ্ত এই বৈঠকে দুই নেতা বাংলাদেশ-কানাডা সম্পর্ক জোরদার করা, স্বাধীনতা গভীরতর করা, প্রতিষ্ঠান গঠন এবং বাংলাদেশের যুবকদের সহায়তার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ইতালীয়রা বাংলাদেশের বন্ধু উল্লেখ করে রোম ও ঢাকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘নতুন অধ্যায়’ সূচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মেলোনি বলেন, ইতালি গুরুত্বপূর্ণ খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পদক্ষেপে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করবে। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন ও সার্বিক সংস্কারের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কমিটমেন্ট, বিদেশি সাহায্য, আনুদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর এ ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তি’ ড. ইউনূসের যোগাযোগ মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কেননা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা সর্বোপরি পুরো বিশ্বে তার যোগাযোগ রয়েছে এবং ইতিবাচক ইমেজ রয়েছে।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সরকারপ্রধানদের ভালো সম্পর্ক এবং যোগাযোগ বহু আগে থেকেই ছিল। সরকারের প্রধান হওয়ার কারণে তাদের পুরোনো সম্পর্ক আবার নতুনভাবে ঝালাই করা হলো এবং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে যাদের সঙ্গেই তার দেখা হয়েছে, সবাই সহায়তা ও জোরালো সমর্থনের কথা বলেছেন। এমনকি ড. ইউনূস সরকারের দায়িত্বে থাকার কারণে ভারতও আমাদের সঙ্গে নতুন প্রেক্ষাপটে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে।
আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, সহযোগিতাগুলো বাস্তবায়ন করা একটা চ্যালেঞ্জ। এটা করতে যে সাংগঠনিক শক্তি লাগবে, সেটা শুধু উপদেষ্টাদের দিয়ে সম্ভব নয়, রাষ্ট্রের সব অংশীজনকে (স্টেকহোল্ডার) ভূমিকা রাখতে হবে। সব ক্ষেত্রে এক ধরনের অব্যবস্থাপনা আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। সেগুলো সঠিক পথে আনার প্রয়োজন আছে। কাঠামোগত যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. এম হুমায়ূন কবির কালবেলাকে বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের এই সমর্থন খুবই কাজে আসতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টরে আমরা যে সংস্কার (রিফরম) চাচ্ছি, স্টোলেন মানি (পাচারকৃত অর্থ) ফেরত আনতে চাচ্ছি, এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা খুবই কাজে লাগবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আমরা যে সংস্কার আনতে চাচ্ছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা যে অবস্থান নিতে যাচ্ছি, পোশাক শ্রমিক সংস্কার চাচ্ছি—এসব ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্নভাবে তাদের থেকে সহযোগিতা পেতে পারি।
তিনি বলেন, আমাদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে আমরা এগুলো কতটুকু কাজে লাগাতে পারছি। আমাদের কী প্রয়োজন, সেটার মূল্যায়ন আমাদেরই করতে হবে। ড. ইউনূস বিশ্বের কাছ থেকে যে ইতিবাচক সমর্থন আদায় করলেন, সেটা অন দ্য গ্রাউন্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকেও সমর্থন তার (ইউনূস) অবশ্যই দরকার হবে। সেটা সরকারে আরও যারা উপদেষ্টা আছেন, আমলা, নাগরিক সমাজ সবারই এখানে ভূমিকা পালন করার আছে। তাহলেই একটা গণতান্ত্রিক দেশ, একটা আইনের (শাসনের) দেশ, একটা মানবিক দেশ, একটা আধুনিক দেশ গঠন হবে।