১৯৮৬ সালে নির্মাণ করা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ ‘এমটি বাংলার জ্যোতি’।
নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে জাহাজটিকে নিবন্ধন দেওয়া হয় ১৯৮৮ সালে। ৩৮ বছরের পুরোনো জাহাজটি অনেক আগেই স্ক্র্যাপিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএসসি। কিন্তু স্ক্র্যাপিং না করেই ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটি ব্যবহার করা হচ্ছিল ক্রুড লাইটারিংয়ে কাজে, যে কারণে সোমবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় তেলবাহী জাহাজেটিতে ঘটে বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের আগে জাহাজটিতে অবস্থান করছিলেন ৪০ জন। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বাকিরা সরে গেলেও ঘটনাস্থলেই অঙ্গার হয়ে যান তিনজন।
এদিকে এ ঘটনার তদন্তে তিনটি পৃথক কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএ) এবং বিএসসি। সেদিন রাতেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরিফ হাসনাত। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের অভ্যন্তরীণ আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি।
জানা যায়, আবুধাবি থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রায় ৯৮ হাজার ৩৮৩ টন মারবান ক্রুড অয়েলবাহী মাদার ভ্যাসেল এমটি ওমেরা লিগেসি কুতুবদিয়ার বহির্নোঙরে আসে। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ক্রুড লাইটারিং শুরু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে এমটি বাংলার জ্যোতি ১১ হাজার ৭১৬ দশমিক ৪৪৬ টন ক্রুড অয়েল নিয়ে ডলফিন জেটি-৭-এ আসে। সকাল ১০টায় খালাস শুরু হয়। ১০টা ৫৪ মিনিটে ক্রুড খালাসের সময় জাহাজের সম্মুখভাগে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন লাগে। দুপুর আড়াইটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন সৌরভ কুমার সাহা (ক্যাডেট), মো. নুরুল ইসলাম (হাইলি স্কিলড ডিজেল মেকানিক) এবং মো. হারুন (দৈনিকভিত্তিক)। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, দুর্ঘটনার আগেও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল; কিন্তু বিপিসি তাদের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) বাণিজ্যিকভাবে চালু না করায় অনেকটা বাধ্য হয়েই এমটি বাংলার জ্যোতিকে ক্রুড লাইটারিংয়ে ব্যবহার করেছে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক। তিনি বলেন, আমরা ইচ্ছা করে জাহাজটি ব্যবহার করিনি। দেশের স্বার্থে, জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলার জ্যোতিকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কারণ বিপিসি তাদের এসপিএম প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসপিএম নির্মাণ হয়েছে। এসপিএম পুরোপুরি কার্যকর হলে আমাদের ট্যাঙ্কার জাহাজ দুটির আর প্রয়োজন হবে না। আরও আগে থেকেই বিপিসি এসপিএম চালুর কথা ছিল। সে অনুযায়ী বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে এসপিএম পুরোপুরি চালুর কথা রয়েছে। তখন চাইলেও ইন্টারন্যাশনাল রুটে আমি জাহাজ দুটি চালাতে পারব না। তারপরও যদি বিপিসির ক্রুড লাইটারিং করতে হয়, সেজন্য জাহাজ দুটি মেরামতের জন্য এক মাসের সময় চাইব। এক মাসের মধ্যেই বাকি জাহাজটির ইঞ্জিনের যত কাজ আছে তা করে নেব।
তিনি আরও বলেন, জাহাজের প্রি-ডকিং শিডিউল থাকে। কিন্তু এ জাহাজের ক্ষেত্রে কোনো ডকিং শিডিউল ছিল না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জাহাজটি আমরা ব্যবহার করছি। কারণ এসপিএম চালু হলে জাহাজ দুটির কোনো প্রয়োজন পড়বে না। আবার এখন এসপিএম চালু না হলেও বিপিসির ক্রুড লাইটারিং করার জন্য দুটি জাহাজ কিনতে হলে অন্তত ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা লাগবে। নতুন জাহাজ কিনলেও এসপিএম চালু হলে তাও কাজে আসবে না।
বিপিসি ও বিএসসির দুই তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার। তিনি সোমবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন। বিপিসির গঠিত কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনিও দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটি পরিদর্শন করেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাহাজের স্টোররুমে বিস্ফোরণটি হয়। স্টোররুমে খুব সম্ভবত গ্যাস জমে ছিল। নিয়মমাফিক জাহাজের স্টোর খুললে একটি নির্ধারিত ফ্যান চালু করতে হয়। ওই ফ্যানটি চালু করতেই বিস্ফোরণটি হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণের সময় স্টোরের মধ্যে নিহত তিনজনই ছিলেন। তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।’
কমিটির পর্যবেক্ষণ: বিপিসির গঠিত কমিটি পাঁচ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের সম্মুখভাগে অবস্থিত ফোর পিক স্টোর (জাহাজের রশি, নোঙর, স্পেয়ার পার্টস রাখার স্থান) থেকে বিস্ফোরণের ফলে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই ফোর পিক স্টোরে বিপুল পরিমাণ ফ্লামেবল গ্যাস জমা হওয়ার কারণে এ ধরনের তীব্র বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে কমিটি মনে করে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে জাহাজের সম্মুখভাগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।