‘মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো, ভ্রাতৃবৃন্দ/কারণ, মৃত্যু যে আসবে, তা অনিবার্য’—মৃত্যু সম্পর্কে এই দর্শন নিয়ে গড়ে উঠেছিল সুফি সমাজ। বর্তমানে আমাদের আত্মকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই দর্শনের ঠাঁই খুব অল্প জায়গাজুড়েই। তবে সব সাধারণেই রয়েছে কিছু ব্যতিক্রম। জনসংখ্যাবহুল এই দেশে যেন সুফিদের ধারণা নিয়েই প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। মৃত্যুর সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধসহ দেশের বিভিন্ন দুর্যোগকালীন মুহূর্তে কাজ করে যাচ্ছেন এই বাহিনীর সদস্যরা। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ৪৭ জন কর্মী নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অগণিত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম আগুন নেভাতে গিয়ে মারা যান ফায়ারফাইটার নুরুল আলম। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে আগুন নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারান তিনি। এরপর একে একে ঝরে যায় আরও ৪৬টি তাজা প্রাণ। কেউ মারা গেছেন অগ্নিনির্বাপণ নিয়ে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায়, কেউ মারা গেছেন অগ্নিনির্বাপণের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, কেউ মারা গেছেন আগুন নেভানোর সময় দেয়ালচাপা পড়ে, কেউ মারা গেছেন অগ্নিনির্বাপণের সময় বিস্ফোরণে। কেউ মারা গেছেন ডুবুরির কাজ করাকালীন পানির নিচে আটকে পড়ে। সর্বশেষ ২৫ নভেম্বর সচিবালয়ে আগুন নেভানোর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্মম সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২৪ বছরের তরতাজা যুবক চৌকস ফায়ারফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন।
ফায়ারফাইটার নুরুল আলমের পর ১৯৭৩ সালে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান টাঙ্গাইল ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার আরশাদ খান। ১৯৮১ সালে আগুন নেভাতে গিয়ে মারা যান রাজধানীর পলাশী ফায়ার ব্যারাকের ফায়ার লিডার মো. ইউনুছ। ১৯৮২ সালে আগুন নেভাতে গিয়ে মারা যান রাজবাড়ী ফায়ার স্টেশনের ফায়ার লিডার মুনির আহমেদ। একই বছর চট্টগ্রামে আগুন নেভাতে গিয়ে মারা যান চট্টগ্রাম ফায়ার স্টেশনের ফায়ার লিডার শরফুদ্দিন আহাম্মদ। এরপর ১৯৮৮ সালে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন নীলফামারীর সৈয়দপুর ফায়ার স্টেশনের ড্রাইভার মো. আমিনুল হক এবং ফায়ারফাইটার আব্দুল মান্নান। ১৯৮৯ সালে বগুড়া ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মাহবুবুর রহমান অগ্নিনির্বাপণের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান। ১৯৯১ সালে দায়িত্ব পালনের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান নওগাঁ ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মুসলিম উদ্দিন। ১৯৯৬ সালে অগ্নিকাণ্ডে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে মার খেয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারান চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার অনিরুদ্ধ বড়ুয়া। ২০০০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সাতক্ষীরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ার লিডার মো. সাজ্জাদ হোসেন এবং ফায়ারফাইটার মো. আতিউর রহমান। একই সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান শেরপুর ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার দুলাল উদ্দিন। ২০০১ সালে অগ্নিনির্বাপণের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার জহিরুল হামিদ। একই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান বরিশাল সদর ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মাহবুব হোসেন খান। ২০০৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ওসমানী ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার আক্তার হোসেন। পরের বছর ২০০৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের ফায়ারফাইটার ফজলুল হক। ২০০৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান কুলাউড়া ফায়ার স্টেশনের ফায়ার লিডার আ. রশিদ। ওই বছর দায়িত্ব পালন করতে এক নির্মম সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কুলাউড়া ফায়ার স্টেশনের ড্রাইভার আজিজুল হক হাওলাদার, ফায়ারফাইটার নিলেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ এবং আবুল কালাম আজাদ। ২০০৯ সালে অগ্নিনির্বাপণের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার আবুল কালাম আজাদ। ওই বছর ছাগলনাইয়া ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মো. জালাল উদ্দিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
২০১৩ সালে অগ্নিনির্বাপণের সময় দেয়াল ধসে মারা যান চট্টগ্রামের নিউমুরিং ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মো. আবু সাইদ। ২০১৫ সালে নির্মম সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান গোপালগঞ্জ ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মো. শাহ আলম। ২০১৭ সালে জঙ্গি দমন অভিযানে গেলে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গোদাগাড়ী ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার আব্দুল মতিনকে। ২০১৯ সালে উদ্ধার কাজের সময় প্রাণ হারান কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার সোহেল রানা। ২০২০ সালে অগ্নিনির্বাপণে যাওয়ার পথে গাড়ির মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান সরিষাবাড়ী ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার কাইয়ুম খান। ২০২১ সালে নদীতে ডুবুরি কাজের সময় মারা যান রংপুর ফায়ার স্টেশনের ডুবুরি আব্দুল মতিন। ২০২১ সালে অগ্নিনির্বাপণ থেকে ফেরার পথে গাড়ির মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ফায়ার ফাইটার মোহাম্মদ মিলন।
২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় আগুন নির্বাপণের সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান কুমিরা ফায়ার স্টেশনের লিডার মিথু দেওয়ান, মো. এমরান হোসেন মজুমদার, নিপন চাকমা, ফায়ার ফাইটার মো. রানা মিয়া, আলাউদ্দিন, মো. শফিউল ইসলাম, গাউছুল আজম, মো. শাকিল তরফদার, রমজানুল ইসলাম, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, রবিউল ইসলাম, মো. ফরিদুজ্জামান এবং নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট মনিরুজ্জামান।
২০২৩ সালে অগ্নিনির্বাপণে যাওয়ার পথে গাড়ি চালাতে চালাতেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ ফায়ার স্টেশনের ড্রাইভার জাহাঙ্গীর হোসেন। ২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছ কাটার সময় বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান খাগড়াছড়ি ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মো. রাসেল হোসেন। সর্বশেষ সচিবালয়ে আগুন নেভানোর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্মম সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান নয়ন।
মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও খুবই স্বল্প ঝুঁকিভাতা নিয়ে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা। ২০১৮ সালে তৎকালীন সরকারের সময় যে ঝুঁকিভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিল, দীর্ঘ ৬ বছর পরে এসেও একই ঝুঁকিভাতা নিয়ে কাজ করছেন তারা। এ ছাড়া অপারেশনাল কাজে গেলেও ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো ঝুঁকিভাতা পান না।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আগুন নেভানোর কাজে সরাসরি যুক্ত ১৭ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ১৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০০ টাকা পর্যন্ত ঝুঁকিভাতা পান। ১৬ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ১৬০০ থেকে ৩২০০ টাকা পর্যন্ত ঝুঁকিভাতা পান। ১৫ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত ঝুঁকিভাতা পান। ১৪ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত, ১৩ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত, ১২ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ২ হাজার ১০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৪০০ টাকা, ১১ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত এবং ১০ গ্রেডের একজন সদস্য চাকরির বয়স হিসেবে সর্বনিম্ন ২ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৫ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত ঝুঁকিভাতা পান।
ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে সব স্তরের সদস্য এবং কর্মকর্তারা সবাই ফায়ার ফাইটার। তখন কারও বসে থাকার সুযোগ নেই। একসঙ্গে সবাই মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অপারেশনাল কাজে গেলেও ১০ গ্রেডের ওপরে থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য কোনো ঝুঁকিভাতা নেই। ঝুঁকিভাতা পেলে সেসব কর্মকর্তা আরও উৎসাহিত হবেন।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা তালহা বিন জসীম বলেন, দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডসহ বহুমাত্রিক দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়েছে। তাই ঝুঁকিভাতার পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এতে একজন ফায়ার কর্মী নিজেদের নিরাপদ মনে করবে, যা কাজের উৎসাহ জোগাবে।