

সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এমন অভিযোগ স্থানীয় জেলে, আউটসোর্সিং কর্মী ও কিছু বনকর্মীর। মাঠপর্যায়ে কথিত প্রভাবশালী এই গোষ্ঠীর বাইরে গেলেই শুরু হয় বদলির প্রক্রিয়া, আর বিপরীতে সিন্ডিকেটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ চাপা পড়ে যায়।
সম্প্রতি বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের আউটসোর্সিং কর্মী শিশু মণ্ডলকে ঘিরে বিতর্ক নতুন করে সামনে এসেছে। কাঁকড়া বিক্রি, চাঁদা আদায় ও নৌকা তালিকা বাণিজ্য নিয়ে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি আরও আলোচনায় আসে। তবে ভিডিওতে নাম উঠে আসা শিশু মণ্ডলকে সরানো হয়নি; বরং বদলি করা হয়েছে জামাল নামের এক আউটসোর্সিং কর্মীকে।
বন বিভাগের নথি বলছে, গত ১০ নভেম্বর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. ফজলুল হকের স্বাক্ষরে আউটসোর্সিং কর্মী জামালসহ ১২ জনকে বদলি করা হয়। কিন্তু দুই মাস না যেতেই আবার মৌখিক আদেশে জামালকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় কয়েকজন কর্মী অভিযোগ করেন, বদলি আদেশ কাগজে পাওয়া যায়, কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন।
উদাহরণ হিসেবে তারা জানান, সেবাকর্মী সিরাজুল ইসলামের কর্মস্থল কদমতলা; কিন্তু তিনি মৌখিক নির্দেশে কাজ করছেন কোবাদকে। এফজি আমিনুল ফকিরের কর্মস্থল হলদিবুনিয়া হলেও তাকে রাখা হয়েছে মুন্সীগঞ্জ টহলফাঁড়িতে। বিএম বাবুল আক্তারের দায়িত্ব ট্যাংরাখালী হলেও তিনি কাজ করছেন দোবেকিতে।
বন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাতক্ষীরা রেঞ্জে বদলির ক্ষেত্রে নিয়মের চেয়ে ‘সিন্ডিকেটের স্বার্থ’ বেশি গুরুত্ব পায়।
তথ্য অনুযায়ী, স্মার্ট বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে শিশু মণ্ডল বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে প্রায় ১৪০টি অবৈধ নৌকার তালিকা নেন।
অভিযোগ রয়েছে, তালিকায় নাম থাকলে অভয়ারণ্য-নিষিদ্ধ এলাকায়ও সেই নৌকা নির্বিঘ্নে চলাচল করে। অয়ন, কামরুল, হোসেন, আকবর, শরিফ, লুৎফা, আবু সালেহ এমন অন্তত সাতটি কোম্পানির নৌকায় বাধাহীন প্রবেশাধিকার ছিল বলে স্থানীয় জেলেরা দাবি করেন।
প্রতিটি নৌকা থেকে মাসে ৫০০ টাকা করে সংগ্রহ করা হতো বলে অভিযোগ। এতে শুধু সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবের পকেটেই যেত প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ টাকার ভাগ যেত স্টেশন কর্মকর্তা জিয়া, এফজি মেজবাহ্ ও রেঞ্জ কর্মকর্তার হাতেও এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
আর স্মার্টবাহিনী বনকর্মীদের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনার আগে ও পরে আদায় হতো আলাদা অর্থ। জেলেদের দাবি, নৌকা প্রতি দিতে হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
জানা গেছে, গত ১৬ নভেম্বর নতুন করে সাতজন আউটসোর্সিং কর্মীকে গোপনে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ এসেছে। নিয়োগে মোটা অঙ্কের লেনদেন হয়েছে এমন অভিযোগও করেন কয়েকজন নৌকা মালিক।
তাদের দাবি, নাম তালিকায় উঠলেই অভয়ারণ্য যেন উন্মুক্ত। কিন্তু তালিকায় না থাকলে নৌকা আটক, জাল জব্দ কিংবা জরিমানা সবই নিশ্চিত।
এক কোম্পানির মালিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, স্মার্টবাহিনী নামার আগে অভয়ারণ্যে যারা মাছ ধরে, তাদের তালিকা দিতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে নৌকা নিয়ে যায়।
রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. ফজলুল হক বলেন, শিশু মণ্ডলের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নেব। তবে কেন তাকে সরানো হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডিএফও চাইলে মৌখিকভাবেও যাকে খুশি বদলি করতে পারেন।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (পশ্চিম) এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, জামালের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ থাকায় তাকে সরানো হয়েছে। শিশু মণ্ডল কেন এখনো বহাল এই প্রশ্নটি খতিয়ে দেখা হবে।
স্থানীয় জেলে সমাজের দাবি, বন বিভাগের নিয়মকানুন নেই, আছে সিন্ডিকেটের নিয়ম। নৌকা, জাল, পাস সবই যেন টাকার ওপর নির্ভরশীল।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের বাস্তবতা ঠিক কেমন তার চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে তারা বলেন, যে সিন্ডিকেটে নেই, তাকে বদলি; আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের টিকিয়ে রাখাই এখানকার নিয়ম।
মন্তব্য করুন