

রাজধানীর পূর্বাচলে রাজউকের প্লট বরাদ্দে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতারণা করেছেন ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কৃত করেছেন বলে রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারক। দুদকের করা শেখ হাসিনার তিন মামলায় ৭ বছর করে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) ঢাকার বিশেষ জজ-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, প্লট বরাদ্দের চেয়ে শেখ হাসিনা আবেদন করলেও কোনো অ্যাফিডেভিট দেননি। পরে রাজউক থেকে শেখ হাসিনার কাছে অ্যাফিডেভিট চাওয়া হয়। তিনি অ্যাফিডেভিট দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক তিনি তার স্বামীর নামে আগে থেকে যে প্লট বরাদ্দ ছিল, তা তিনি উল্লেখ করেননি। এটা এক ধরনের প্রতারণা। এ ছাড়া সে হলফনামায় কোনো আইনজীবী, নোটারি পাবলিক বা ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর নেই। দুটি হলফনামা দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু একটারও ভ্যালিডিটি নেই। পরে আবার রাজউক থেকে সঠিক তথ্য চাওয়া হয়।
বিচারক আরও বলেন, কর্মকর্তা কর্মচারীদের তিনি (শেখ হাসিনা) বলেছেন, তোমরা অন্যায় করলেও আমি তোমাদের পুরস্কৃত করব। রাজউক গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। প্রতিমন্ত্রী (তৎকালীন) সবকিছু জানা সত্ত্বেও তিনি বাধা দেননি। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। দুর্নীতিবাজদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। কিন্তু যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়নি তারা চাকরি জীবন নিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। এ রায়ের মাধ্যমে প্রকৃতরা যেন প্লট বরাদ্দ পান, সে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আদালত বলেন, 'শেখ হাসিনার সম্পদের প্রতি লোভ আছে। উনি বরাদ্দ না চাইলে কাগজ ছুড়ে ফেলতে পারতেন। প্লট না নিতে পারতেন। ওনার লিগ্যাল অ্যাডভাইজার, ল মিনিস্টার আছে। তাদের দিয়ে মানা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নেন। এক্ষেত্রে রাজউক, গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় ও শেখ হাসিনা অপরাধ করেছেন। শেখ হাসিনা প্রতারণা করেছেন।'
এ ছাড়া দুদকের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ৫ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অন্য আসামিদেরও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন।
গত ২৩ নভেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন আদালত। যুক্তিতর্কে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন প্রত্যাশা করেন রাষ্ট্রপক্ষ। তবে পলাতক থাকায় শেখ হাসিনাসহ পরিবারের পক্ষে নেই কোনো আইনজীবী। এদিকে মামলা তিনটির একটিতে শেখ হাসিনাসহ আসামি ১২ জন, আরেকটিতে জয় ও শেখ হাসিনাসহ ১৭ জন, বাকি আরেকটি মামলাতে পুতুল ও শেখ হাসিনাসহ আসামি ১৮ জন।
এর আগে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে পৃথক ৬ মামলা করে দুদক। সব মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। এরপর ৩১ জুলাই শেখ হাসিনাসহ এই তিন মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়।
এসব মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তারা বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও গরিব দেখিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩নং রাস্তার ৬টি প্লট শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দ দেন।
জয় ও পুতুলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ : জয়ের নামে রাজউকের এখতিয়ারাধীন এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরও তা হলফনামায় গোপন করে পূর্বাচল নতুন শহর আবাসন প্রকল্পে আইন লংঘন করে মাকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। পরে রেজিস্ট্রি করে সরকারি জমি আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া পুতুল মাকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে রাজউকে কোনো আবেদন না করেই মায়ের কাছে আবদার করে আবেদন পেশ করেন। এরপর ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব আসামি মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন নিজে ও অপরকে শাস্তি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একটি নথি বিনষ্ট করেছেন অথবা গায়েব করেছেন মর্মে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে।
যদিও জুলাই আন্দোলন দমনের চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শেখ হাসিনাকে ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মন্তব্য করুন