ময়লার ভাগাড়ে নবজাতকের কান্নার শব্দে এগিয়ে যান সুজন মিয়াসহ কয়েকজন। ভাগাড়ের সামনে গিয়ে চোখ আটকে যায় তাদের। কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে এক নবজাতক। করুণ এ দৃশ্য এড়িয়ে যেতে পারেননি তারা। নিয়ে যান স্থানীয় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ঘটনাটি গত ৩০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া চৌরাস্তার জালাল টাওয়ারের পাশের ভাগাড়ের।
প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে হস্তান্তর করা হয় উপজেলা সমাজসেবা অফিসারের কাছে। খবর পেয়ে মাতুয়াইল শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) পরিচালক ও এনআইসিইউ প্রধান ডা. মো. মজিবুর রহমান সেদিন রাত ২টার পরে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সোনারগাঁয়ে গিয়ে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন নবজাতকটির। এরপর থেকে ওই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আইসিএমএইচতে চিকিৎসা দেওয়া হয় নবজাতকটিকে। গত রোববার নবজাতকের (কন্যা) নাম রাখা হয় নায়লা। নাম রাখা প্রসঙ্গে ওই চিকিৎসক জানান, নায়লা অর্থ হলো আল্লাহর সহায়তাপূর্ণ। শিশুটির যেহেতু বাবা-মায়ের পরিচয় জানা নেই, তাই এ নাম রাখা হয়েছে। যেন আল্লাহ শিশুটির পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেন।
ওই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আরও এক নবজাতকের চিকিৎসা চলছে আইসিএমএইচে। গত ৬১ দিন আগে যাত্রাবাড়ী ডেল্টা হাসপাতালের সিঁড়ির নিচে কাগজে মোড়ানো এক নবজাতকের সন্ধান পাওয়া যায়। এ খবর ডা. মজিবুর রহমানের কাছেও পৌঁছায়। তখন তিনি ছুটে যান ওই হাসপাতালে। নিজের তত্ত্বাবধানে গত ৬১ দিন ধরে চিকিৎসা দিচ্ছেন। শুরুতে নবজাতকের শারীরিক অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে, ২৬ দিন তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয়েছে। ১৬ দিন ধরে চার হাজার টাকার বেশি দামের ইনজেকশন দিয়ে রাখতে হচ্ছে শিশুটিকে। তবে এ দুই শিশুর শারীরিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ডেল্টা হাসপাতালের সিঁড়ির নিচে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর নাম রাখা হয়েছে জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আন্দোলনরতদের পানি খাওয়াতে গিয়ে শহীদ হওয়া মুগ্ধর নামে। ওই চিকিৎসকের আশা এ মুগ্ধও একদিন জাতির জন্য নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে।
যেভাবে শুরু এ যাত্রার: ২০১৬ সালে আইসিএমএইচে ডা. মজিবর রহমানের তত্ত্বাবধানে নিউবর্ন বেবিদের এনআইসিইউ চালু করা হয়। ওই সময়ে এক নারী পলিথিন মুড়িয়ে এক নবজাতককে ফেলে যায় ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। ডা. মুজিব তখন ওই নবজাতকের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। এরপর কোথাও নবজাতক উদ্ধারের খবর পেলে তিনি ছুটে যান চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে। গত ৮ বছরে এ চিকিৎসক ৪৩ নবজাতককে উদ্ধার ও চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। তার মধ্যে চারজন নবজাতকের মৃত্যু হলেও ৩৯ জনকে আদালতের মাধ্যমে দত্তক দিয়েছেন বিভিন্ন পরিবারে। পুলিশের সহায়তায় একজন শীর্ষ রাজনীতিবিদ একটি নবজাতকের বাবা-মাকে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা থেকে খুঁজে বের করে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি এমন আরও দুজন নবজাতকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন।
আইসিএমএইচের চিকিৎসক মজিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ৪৩ নবজাতক উদ্ধারের এ জার্নিতে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ময়লার ভাগাড়ে ফেলে যাওয়া এমন নবজাতকও পেয়েছি যার হাত-পা কুকুরে খেয়ে ফেলেছে। তাদের উদ্ধার করে চিকিৎসা শেষে আদালতের মাধ্যমে দত্তক দিয়েছি।
তিনি বলেন, যারা সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণে এসব নিষ্পাপ শিশুকে ময়লার ভাগাড়ে ফেলে যান, তাদের অনুরোধ করব, দয়া করে তাদের কষ্ট দেবেন না। সন্তানকে ফেলে রেখে আপনারা শান্তিতে থাকতে পারবেন না। যদি পরিস্থিতির শিকার হন, দয়া করে আমাকে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে জানান। আমার ফোন নম্বর ০১৮১৭৭৭৭৭২২। আমরা আপনার থেকে নবজাতককে নিয়ে এসে দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসা ও দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা করব। তবুও নিষ্পাপ নবজাতককে কষ্ট দিয়েন না।