কোটা সংস্কার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নিল গণঅভ্যুত্থানে। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর নেতৃত্বদানকারীরা জুলাই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষায় দেশ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে সরকার পতনের প্রায় সাত মাস পর নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটল। তারুণ্যের শক্তিতে উদ্দীপ্ত গণআন্দোলনের মূল নেতাদের সামনের সারিতে রেখে গঠিত দলের নাম ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’। রাজপথের নেতাদের নিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান দেখল দেশবাসী। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃত্বে থাকাদের উদ্যোগে গঠিত দলটির তরুণ নেতৃত্ব দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করতে, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে এবং সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ করার মাধ্যমে নতুন এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। দলটির আহ্বায়ক হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ ছেড়ে আসা তরুণ ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম। আর সদস্য সচিব হয়েছেন ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের পর রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিকশিত হয়েছে। চব্বিশের গণআন্দোলনের পরও একই আকাঙ্ক্ষা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটল।
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে সে সময় আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল।
ফের গত বছরের ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে সরকারের দমনপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে একপর্যায়ে এটি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। এর মাঝেই ১৫৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সর্বশেষ গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে গেলে লিখিত হয় নতুন ইতিহাস।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দল গঠন ও গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ রেখে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে গত ৮ সেপ্টেম্বর ৫৫ সদস্যের জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। পরে তিন ধাপে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৮৭ জনে উন্নীত করা হয়। দল গঠনের প্রস্তুতি হিসেবে এই কয়েক মাসে সারা দেশে ১৫৯টি থানা কমিটি, ২৭৩টি উপজেলা কমিটি, ১৫টি মহানগর ওয়ার্ড কমিটি এবং ১০টি পেশাজীবী শাখা ঘোষণা করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
নাগরিক কমিটির নেতাদের ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন রাজনৈতিক দলে উদারপন্থি, ইসলামপন্থি, ডানপন্থি, বামপন্থি এবং রাষ্ট্রের সংস্কারপন্থিদের সম্মিলন হবে। তবে এই দল গঠনের পথ মসৃণ ছিল না।
মাঝে মাঝে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে। পদ ও নেতৃত্ব নিয়ে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে টানাপোড়েন প্রকাশ্যে এসেছে। যে কারণে অঙ্কুরেই বিশৃঙ্খলার শঙ্কা করেছিলেন অনেকেই। তবে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান ঘিরে কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি।
এদিকে দল ঘোষণা নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির বার্তা হলো, নতুন দল গঠিত হওয়ার পর পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে বর্তমান আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখপাত্র ও মুখ্য সংগঠক দায়িত্ব নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবেন। বর্তমানে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্ব নতুনদের কাছে হস্তান্তর করবেন। নতুন নেতৃত্ব পরবর্তীতে তাদের সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন নির্বাহী কমিটিতে কারা থাকবেন, সেল ও সম্পাদকীয় পদগুলোতে কারা থাকবেন। তবে দলে যোগ দিচ্ছেন না—এমন সদস্যদের সদস্যপদ বহাল থাকবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, উপজেলা, থানা ও ওয়ার্ডে তাদের যে প্রতিনিধি কমিটিগুলো গঠিত হয়েছিল এবং পেশাজীবীদের নিয়ে যে উপকমিটি বা প্রতিনিধি কমিটি হয়েছিল, সেসব কমিটির যেসব সদস্য রাজনৈতিক দলে যুক্ত হতে ইচ্ছুক, তারা নাগরিক কমিটি থেকে রাজনৈতিক দলে কোন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন, সেটি দ্রুত সময়ের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে।
এর আগে ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৩ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আন্দোলনের পর ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। দলের নাম ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’। তবে পরবর্তী সময়ে এই দলের মধ্যে কিছুটা ভাঙন পরিলক্ষিত হয়।
মন্তব্য করুন